২ আর ৫। দু’টি সংখ্যায় চেপে ফিরে এল পুরনো তর্ক। জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। নতুন করে।
৮ নভেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল জল্পনা— কেমন হবে নতুন নোটের চেহারা, কেমনই বা তার রং আর নকশা। উৎসুক জনতার মনে উঁকি মারছিল এমন হাজারো প্রশ্ন। সরকারি কর্তারা অচিরেই নতুন টাকার নমুনা টেলিভিশনে দেখিয়ে দেন। দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়া-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় তার ছবি। সেখানে গাঁধীজির ছবির জায়গা বদল, স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের বিজ্ঞাপন বা মঙ্গলযানের ছবি চোখে পড়েছে সকলেরই।
কিন্তু সে সব ছাপিয়েও উঠে এসেছে আর একটি ব্যাপার। নতুন ২০০০ আর ৫০০ টাকার নোটে টাকার অঙ্কটা রোমান হরফের সঙ্গে লেখা রয়েছে দেবনাগরীতেও। আর এতেই প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি সরকার কি খিড়কি দিয়ে হিন্দিকে ঢোকাতে চাইছে?
হরফ আর ভাষার তফাত আছে নিশ্চয়ই। দেবনাগরী হরফ, যাতে হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষাও লেখা হয়, যথা সংস্কৃত। কিন্তু ঘটনা হল, টাকার অঙ্ক দেবনাগরীতে লেখা হলে মানুষ সেটা হিন্দি হিসেবেই পড়বেন। এত দিন দশ টাকা হোক আর হাজার টাকা, নোটের গায়ে অঙ্কটা থাকত কেবল রোমান হরফে। এখন ইংরেজির পাশে হিন্দিও জ্বলজ্বল করছে।
আর এতেই নতুন করে শুরু হয়েছে ভারতের জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত এক পুরনো বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সরকারি স্তরে যে ভাবে বারবার জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, নতুন নোটে দেবনাগরী সংখ্যা চালু করা কি সেই উদ্যোগেই আর একটা ধাপ? ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেছেন, ‘‘নতুন নোটে দেবনাগরী হরফে সংখ্যার ব্যবহার হিন্দির প্রতি বেশি ভালবাসা দেখানো বলেই মনে হয়। সংবিধান অনুযায়ী হয়তো এতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। তবে সরকারি ক্ষেত্রে এই ব্যবহার নিশ্চয়ই কোনও একটা ভাষাকে বিশেষ সুযোগ করে দেওয়া।’’ একই মত ইতিহাসবিদ তনিকা সরকারেরও। তাঁর কথায়, ‘‘বেশ কিছু দিন থেকেই হিন্দিকে জোর করে সর্বভারতীয় ভাষা হিসেবে দেখানোর একটা প্রয়াস চলছে। বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্র-সহ প্রকাশনাতেও গুরুত্ব বাড়ানো হচ্ছে হিন্দির। অন্য কোনও ভারতীয় ভাষা সেই মর্যাদা পাচ্ছে না কেন?’’ নতুন নোট চালু না হওয়া পর্যন্ত সে বিষয়ে কিছু না বললেও প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার বলছেন, ‘‘হিন্দিকে যদি ভারতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রেও হিন্দির সেই ঔদার্য দেখানো উচিত।’’
ষাটের দশকে হিন্দি ভাষার ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র নেতৃত্বে হয়েছে বড়সড় আন্দোলনও। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৩ সালে একটি আইন তৈরি করে ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দির পাশাপাশি স্বীকৃত হয় ইংরেজিও। ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা এ ভাবে মেটানো গেলেও সংখ্যার সমস্যাটা ঠিক এতটা সহজ নয়। কারণ প্রায় ৭০ বছর আগেই বলা হয়েছিল যে, দেবনাগরী সংখ্যার ব্যবহার আসলে হিন্দিকে স্বীকৃতি দেওয়ারই সামিল। সে কারণেই ব্যাঙ্কিং, বিজ্ঞান এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংখ্যাই ব্যবহার করা হয়ে এসেছে এত কাল।
সংবিধানের ৩৪৩ নং ধারায় বলা আছে, সরকারি কাজে যে লিপির সংখ্যা ব্যবহৃত হবে, আন্তর্জাতিক স্তরে সেটাই ভারতীয় সংখ্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তবে বলা ছিল এ কথাও যে, সংবিধান চালু হয়ে যাওয়ার ১৫ বছর পরে রাষ্ট্রপতি বিশেষ ক্ষমতাবলে এর সঙ্গে দেবনাগরী সংখ্যা জুড়তে পারেন। সংখ্যার ক্ষেত্রে কোন লিপি ব্যবহার করা উচিত, তা নির্ণয়ের ভার দেওয়া হয়েছিল সরকারি ভাষা কমিশনকে। তারা অবশ্য দেবনাগরী বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
১৯৬০ সালে রাষ্ট্রপতির এক নির্দেশে বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় বিভিন্ন মন্ত্রকের বিশেষ বিশেষ প্রকাশনার ক্ষেত্রে তার ধরন দেখে সেখানে আন্তর্জাতিকের সঙ্গে দেবনাগরী সংখ্যাও থাকতে পারে। এ বার প্রশ্ন উঠছে, টাকাকে কি কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের কোনও ‘প্রকাশনা’ বলে গণ্য করা যেতে পারে? অনেকের মতে, নোট কোনও ভাবেই প্রকাশনা নয়।
কালো টাকা ঠেকাতে নতুন নোট তো বাজারে এল। কিন্তু সেখানেও ফের চলে এল শাসক দলের হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy