শেফালি বর্মা বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছেন। দীপ্তি শর্মা উইকেট তুলছেন। হরমনপ্রীত কৌর ক্যাচ তালু বন্দি করে ছুটছেন।
রবিবারের বিশ্বকাপ ফাইনালের ‘রিলস’ দেখতে মোবাইলের স্ক্রিনের উপরে ঝুঁকে পড়েছে তিনটে মাথা। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের ঘরে। তিন জনেরই দুধের কারবার। কাজকম্ম সেরে পুকুর পাড়ে বসে বিড়িতে সুখটান দেওয়ার সময় নতুন বিনোদন—মোবাইলের রিলস। এক গাল হেসে রজ্জু প্রসাদ বললেন, “ছোরিয়োঁ নে কামাল কর দিয়া। অব ইনকোকওন রোকেগা?”
ক্রিকেট বিশ্বকাপের মতো বিহারের বিধানসভা নির্বাচনেও কি মহিলা ভোটাররাই বাজিমাত করবেন? প্রশ্ন শুনে রজ্জুর মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। “আর বলবেন না। ভোটে জিততে সব পার্টি মহিলাদের হাতে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। এখন মহিলার নিজেরাই ঠিক করছে কে কোন চিহ্নে বোতাম টিপবে। কে কোন জাতের, তা দেখে না। আমাদের কথাও কানে তোলে না।” রজ্জু প্রসাদের পাশে বসা বলরাম যাদব আরও খাপ্পা। সব রাগ নীতীশ কুমারের উপরে। “কী এক জীবিকা দিদি শুরু হয়েছে। ঘরের মহিলারা ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ছে। ঘোমটা দেওয়া নেই। একাই ব্যাঙ্কে যাচ্ছে। বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলছে।” সুর মেলান রঞ্জিত কুমার—“এই রাজনীতির খেলা মহিলাদের পুরুষ বানিয়ে দিচ্ছে।”
বিহারের নালন্দা জেলার চিকসৌরা গ্রাম। গত বিশ বছর ধরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এই নালন্দারই ভূমিপুত্র। দু’দশকে নীতীশ নিজস্ব ‘মহিলা ভোটব্যাঙ্ক’ তৈরি করেছেন। মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ, সরকারি চাকরিতে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ হয়েছে। স্কুলছাত্রীদের সাইকেল বিলি করেছেন। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, জীবিকা কর্মীদের ভাতা বেড়েছে। মদের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতির ফলে ঘরে-বাইরে নারী নিরাপত্তা বেড়েছে। মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি হারে ভোট দিচ্ছেন, তা নয়। চিরাচরিত জাতপাতের হিসেবের ঊর্ধ্বে উঠে ভোট দিচ্ছেন। বিহারের ৭ কোটি ৪৩ লক্ষ ভোটারের মধ্যে মহিলার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। কিন্তু পুরুষদের থেকে মহিলাদের ভোটদানের হার প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। জেডিইউ মনে করছে, এই মহিলা ভোটই ‘পঁচ্চিস সে তিরিশ, ফির সে নীতীশ’-এর স্লোগানবাস্তবায়িত করবে।
নীতীশের মহিলা ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে তেজস্বী যাদব ঘোষণা করেছিলেন, বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন সরকারে এলে মাই বহেন সম্মান যোজনায় প্রতি মাসে ২৫০০ টাকা পাবেন মহিলারা। পাল্টা চালে নীতীশ বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা চালু করে দিয়েছেন। রাজ্যের জীবিকা প্রকল্পে তৈরি ১০ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এককালীন ১০ হাজার টাকা ঢুকছে। ইতিমধ্যেই প্রায় দেড় কোটি মহিলা টাকা পেয়েছেন। সংখ্যাটা দু’কোটিতে পৌঁছবে। বিহার জুড়ে এখন স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে পাশবই হাতে মহিলাদের ভিড়। টাকা কবে আসবে, তার খোঁজ।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, ১০ হাজার টাকায় মহিলারা নিজেদের ইচ্ছে মতো ব্যবসা শুরু করতে পারেন। প্রয়োজনে আরও এক লক্ষ ৯০ হাজার টাকা ঋণ মিলবে। তবে ব্যবসা না করলেও সমস্যা নেই। ওই ১০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে না। যেমন খুশি খরচ করা যাবে। বিরোধীরা তাই একে ‘ভোট কেনার ঘুষ’ তকমা দিয়েছে।
নীতীশের নালন্দা থেকে তেজস্বীর বৈশালী জেলা, চিরাগ পাসোয়ানের হাজিপুর থেকে মুকেশ সাহনির মুজফ্ফরপুর—বিহারের গ্রামে গ্রামে তাসের আড্ডায় একটাই প্রশ্ন, শুধু মহিলারা কেন উপহার পাবেন? পুরুষরা কী দোষ করল?
মুজফ্ফরপুরের লিচু বাগানে ঘেরা সকরা গ্রামে তাস খেলছিলেন নিষাদ সম্প্রদায়ের ধীরজ ও তাঁর বন্ধুরা। ধীরজের প্রশ্ন, “বাড়ির মরদের হাতে ১০ হাজার টাকা দিলে কী ক্ষতি হত?” ধীরজের বন্ধু মোহন ফুট কাটে, “তুই তো সিএনজি খেয়ে ওই টাকা উড়িয়ে দিতিস!” সিএনজি? মোহন বুঝিয়ে দেন, নীতীশ সরকার বিহারে মদের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে গ্রামের দিকে দিশি মদ, তাড়ি বা মহুয়া বন্ধ করা যায়নি। পুলিশকে ফাঁকি দিতে সেই দিশি মদের ‘কোড নেম’ সিএনজি। ধীরজ ক্ষেপে উত্তর দেয়, “মোটেই সিএনজি খেয়ে সব টাকা ওড়াতাম না। পরিবারের চিন্তা আমিও করি। দেখুন গিয়ে, মহিলারা তো ওই টাকায় শাড়ি-গয়না কিনে নিচ্ছে।”
বৈশালী জেলার বিদুপুরের শারদা দেবী মানতে রাজি নন। অনেক দিন ধরেই তিনি গ্রামের ‘জীবিকা দিদি’। দশ জন মহিলার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী বা ‘কমিউনিটি মোবিলাইজ়ার’। গ্রামের মহিলাদের কাছে ‘সিএম’। তাঁর কাছেই মহিলারা মাসে দশ-বিশ টাকা করে জমা করেন। সেই তহবিল থেকে কেউ প্রয়োজনে ধার নিতে পারেন। মাসে এক শতাংশ সুদে টাকা ফেরত দিতে হয়। ১০ হাজার টাকা পেয়ে শারদা দেবী অন্য তিন জনের সঙ্গে মিলে মোষ কিনেছেন। দুধের ব্যবসা শুরু করবেন। এর আগে অনেক মহিলা টাকা ধার নিয়ে সেলাই মেশিন কিনে কাজ করছেন। কেউ ডিমের ব্যবসায় নেমেছেন। আধাশহর, মফস্সলে কমবয়সি মহিলারা বিউটি পার্লার, সাইবার ক্যাফে খুলেছেন।
পটনার চন্দ্রগুপ্ত ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক দেবব্রত সামন্তের মতে, “মহিলাদের ক্ষমতায়ন এখন স্পষ্ট। অনগ্রসর মহিলারাও আর উচ্চবর্ণের পুরুষদের ভয় পান না। ঋণ নিয়ে অনেক মহিলা ব্যবসা শুরু করছেন। আমরা এ জন্য অনেক মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যাঁরা আগামী দিনে ছোটখাটো উদ্যোগপতি হয়ে উঠতে পারেন। শিক্ষিত তরুণীরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে খুবই উৎসাহী।”
তবে মহিলাদের এই ক্ষমতায়ন বিহারে কাকে ক্ষমতায় বসাবে, নির্বাচনী ময়দানে সেটাই প্রশ্ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)