কাছাড়ের আদি বাসিন্দা (ওআই) কারা, সেই বিতর্ককে জিইয়ে রেখেই চলছে এনআরসি-র খসড়া তৈরির কাজ। আঞ্চলিক রেজিস্ট্রাররা আগে যাঁদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ‘ওআই’ চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন ওই তালিকা থেকে বাদ পড়ছেন।
প্রাথমিক পর্যায়ে আঞ্চলিক রেজিস্ট্রাররা (এলআরসিআর) নথিপত্র দেখে অনেকের নামে ‘ওআই’ লিখে দিয়েছিলেন। জেলায় ৪ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৮৮টি আবেদনপত্রে ‘ওআই’ লেখা পাওয়া গিয়েছে। শতাংশের হিসেবে তা মোট আবেদনপত্রের ২৪.৭৯ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে নির্দেশ আসে, শুধু চা জনগোষ্ঠী ও উপজাতিরাই আদি বাসিন্দা হিসেবে নথিপত্র পরীক্ষা থেকে ছাড় পাবেন। ফলে শুরু হয় নতুন করে বাছাইয়ের কাজ। তাতে কাছাড়ে আদি বাসিন্দার হার অনেকটা কমছে।
বাছাইয়ের কাজে জটিলতা কম নয়। আবেদনপত্রে জনগোষ্ঠীগত পরিচিতির কোনও উল্লেখ ছিল না। ফলে নাম দেখেই চা জনগোষ্ঠী ও উপজাতি আবেদনকারীদের শনাক্ত করা হচ্ছে। এ ভাবে ২ লক্ষ ৫৭ হাজার ২১৬টি আবেদনপত্রকে প্রথমে বাছাই করা হয়। এখন চলছে তাদের জনগোষ্ঠীগত পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পালা। এর মধ্যে ১ লক্ষ ২৫ হাজার ৩৮৮ জনের ‘ওআই’ নিশ্চিত হয়েছে বলে বিভাগীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। নাগরিকত্ব প্রমাণে তাঁদের কাগজপত্র পরীক্ষার কোনও প্রয়োজন পড়ছে না। ‘এনওআই’ বলে স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিতদের সংখ্যা ১৬ হাজার ৭০। এখনও ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৭৫৮টি আবেদনপত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কাজ বাকি রয়েছে। সেগুলির ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর কাছাড়ে আদি বাসিন্দাদের হার মোট আবেদনকারীর ১০ শতাংশের বেশি হবে না বলেই অনুমান করা হচ্ছে।
এনআরসি-র দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলাশাসক বি সি নাথ জানিয়েছেন, কাছাড়ে এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছে ৩ লক্ষ ৯৭ হাজার ৭০৫টি। ২০১১ সালের জনগণনায় এখানে মোট পরিবারের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৭৯ হাজার ৯৫৫। নাথবাবুর অনুমান, গত ৬ বছরে পরিবারের সংখ্যা বেড়ে ৪ লক্ষের বেশি হয়নি। ফলে নথিপত্র যা-ই থাক, কাছাড়ে বসবাসকারী প্রায় সবাই এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য আবেদন করেছেন। পরে অবশ্য বংশবৃক্ষ চাইলে প্রায় ২০ হাজার আবেদনকারী আর ও-মুখো হননি। কাছাড় জেলায় বংশবৃক্ষ জমা পড়েছে ৩ লক্ষ ৭৭ হাজার ৮৭৯টি।
আদি বাসিন্দা নিয়ে বরাক উপত্যকার বিভিন্ন সংগঠন শুরু থেকেই প্রতিবাদে মুখর রয়েছে। তাদের দাবি, শুধু উপজাতি এবং চা জনগোষ্ঠীর মানুষই এখানে আগে থেকে বসবাস করছেন, এমন কথা যুক্তিহীন। ব্রিটিশ অধিগ্রহণের বহু আগে থেকে এই অঞ্চলে বাঙালিরা বসবাস করছেন।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাঙালিদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর অধিকার ছিনিয়ে নিতে প্রণালীবদ্ধ চেষ্টা চলছে। এনআরসি নবায়নে ওআই-এনওআই বিভাজন টেনে ভয়ঙ্কর নিগ্রহের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই অঞ্চলের বাঙালিরা যেহেতু অখণ্ড ভারতের নাগরিক ছিলেন, তাই তারাও এ রাজ্যে ভূমিপুত্র, দাবি বরাক বঙ্গের।
শিক্ষাবিদ-প্রাবন্ধিক সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন, ‘‘দেশভাগের আগে শ্রীহট্ট অসমেরই অন্তর্গত ছিল। পরবর্তী জটিল ভূগোলের জন্য দেশবাসীকে দায়ী করা যায় না।’’ একই কথা বলেন নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির প্রধান সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ। জেলাশাসক এস বিশ্বনাথন অবশ্য জানিয়েছেন, ওআই-এনওআই নিয়ে আতঙ্ক-আশঙ্কার কারণ নেই। উপজাতি ও চা জনগোষ্ঠীর মানুষদের রেহাই দিতেই ওআই ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু এনআরসি-র প্রস্তুতিপর্বে সীমিত থাকবে। এনআরসি প্রকাশের পর তাতে ওআই বা এনওআই বলে কিছুই উল্লেখ থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy