Advertisement
E-Paper

ছাড়া পাচ্ছে নির্ভয়ার নাবালক ধর্ষক, আইন বদল ঘিরে প্রশ্ন

সংশোধন আবাসে মাত্র তিন বছর। তাতেই ধর্ষণ-খুন মাফ! ঠিক তিন বছর আগে, ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির এক চলন্ত বাসে নির্ভয়াকে ভয়াবহ ভাবে ধর্ষণ করার পরে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীরের ভেতর থেকে ছিঁড়ে বার করে এনেছিল ছেলেটা। ছ’জন ধর্ষকের মধ্যে সেই ছিল কনিষ্ঠতম। জন্মের শংসাপত্র আর স্কুলের কাগজপত্রে তখন তার বয়স ছিল সতেরো বছর ছ’মাস। আর সেই সুবাদে এই ধর্ষণ-কাণ্ডের ঘৃণ্যতম অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও রবিবার ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে নির্ভয়ার সেই নাবালক ধর্ষক।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:২১
অপরাধের জয় হল... আমরা হেরে গেলাম!’—নির্ভয়ার মা আশাদেবী

অপরাধের জয় হল... আমরা হেরে গেলাম!’—নির্ভয়ার মা আশাদেবী

সংশোধন আবাসে মাত্র তিন বছর। তাতেই ধর্ষণ-খুন মাফ!

ঠিক তিন বছর আগে, ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির এক চলন্ত বাসে নির্ভয়াকে ভয়াবহ ভাবে ধর্ষণ করার পরে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীরের ভেতর থেকে ছিঁড়ে বার করে এনেছিল ছেলেটা। ছ’জন ধর্ষকের মধ্যে সেই ছিল কনিষ্ঠতম। জন্মের শংসাপত্র আর স্কুলের কাগজপত্রে তখন তার বয়স ছিল সতেরো বছর ছ’মাস। আর সেই সুবাদে এই ধর্ষণ-কাণ্ডের ঘৃণ্যতম অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও রবিবার ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে নির্ভয়ার সেই নাবালক ধর্ষক।

এই অপরাধীকে এখনই মুক্তি না দেওয়ার আর্জি জানিয়ে কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নির্ভয়ার বাবা-মা। সেই মর্মে নাবালকের মুক্তির উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানায় কেন্দ্রীয় সরকার। আদালতে একই আর্জি জানান বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীও। কিন্তু আজ বিচারপতি জি রোহিনী ও বিচারপতি জয়ন্ত নাথকে নিয়ে গঠিত দিল্লি হাইকোর্টের বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, দেশের আইনের বাইরে যাওয়ার এক্তিয়ার তাদের নেই। নাবালক বিচার আইনের ১৫ (১) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বিশেষ সংশোধন আবাসে অপরাধীকে তিন বছর রাখা হয়েছে। এর পর আর তাকে সেখানে রাখা যাবে না। ২০ ডিসেম্বরই মুক্তি দিতে হবে।

হাইকোর্ট আজ আরও নির্দেশ দিয়েছে যে, অভিযুক্ত ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে নাবালক বিচার বোর্ড, কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক এবং দিল্লি সরকার যেন তার দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা যেন অবিলম্বে আদালতকে জানানো হয়। দিল্লি সরকারের তরফে রাতেই জানানো হয়েছে, আদালতের নির্দেশ মেনে তারা নাবালক ধর্ষককে এককালীন দশ হাজার টাকার সাহায্য এবং একটি সেলাই মেশিন দেবে। যা শুনে কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মেনকা গাঁধী বলেন, ‘‘এ তো অপরাধ করার জন্য আরও টোপ দেওয়া হল!’’

আজ হাইকোর্টের এই রায়ের পরে ফের প্রশ্ন উঠছে, নাবালক বিচার সংশোধন বিল এত দিনেও কেন পাশ করানো গেল না? নাবালক বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করার জন্য সংসদে ইতিমধ্যেই একটি বিল পেশ হয়েছে। ২০১৪ সালের এই প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী নাবালক বা নাবালিকা জঘন্য অপরাধ (যেমন, ধর্ষণ, হত্যা) করলে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক ধরে নিয়ে বিচার করতে হবে। বিলে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, প্রতিটি জেলায় নাবালক বিচার বোর্ড এবং শিশু কল্যাণ কমিটি গড়ে তোলা হবে। সংশ্লিষ্ট বোর্ড প্রাথমিক তদন্তের পরে স্থির করবে কোনও নাবালক অপরাধীকে সংশোধন আবাসে পাঠানো হবে, নাকি তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে গণ্য করা হবে।

কিন্তু বিলটিতে আপত্তি জানায় বহু শিশু অধিকার সংস্থা। তা ছাড়া, শিশু অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের নীচে সমস্ত শিশুকে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো সমান চোখে দেখবে। ভারতও এক স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই এই বিলে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবের বিরোধী। এই সব টানাপড়েনে বিলটি এখনও রাজসভায় পাশ হয়নি। সেটি সংসদীয় সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অনেক দিন ধরেই মেনকা গাঁধী অবশ্য এই সংশোধনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে চলেছেন। আজ হাইকোর্টের রায়ের পরে তিনি বলেন, ‘‘এর জন্য আমি রাজ্যসভাকেই দায়ী করছি। সংশোধনীটি এত দিন পাশ হয়ে গেলে অপরাধী এ ভাবে ছাড়া পেয়ে যেত না।’’ দিল্লির মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী মালিওয়ালও জানিয়েছেন, তাঁরা রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আবেদন জানিয়েছেন, তিনি যেন হাইকোর্টের রায়টি পুনর্বিবেচনা করেন। একই আর্জি নিয়ে তাঁরা দিল্লি হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে যাবেন বলে জানিয়েছেন স্বাতী।

এ বছর ১৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির যন্তর-মন্তরে মেয়ের স্মরণসভায় নির্ভয়ার মা আশা দেবী বলেছিলেন, ‘‘আমার মেয়ের নাম জানিয়ে দিচ্ছি— জ্যোতি সিংহ। নাবালক অপরাধীর নামটাও এবার জানানো হোক। ওকে আটকে রাখা হোক।’’ আজ রায় শুনে আদালত কক্ষেই আশা দেবী অস্ফুটে বলে ওঠেন, ‘‘অপরাধের জয় হল... আমরা হেরে গেলাম!’’ তাঁর কথায়, ‘‘তিন বছর ধরে এত লড়াইয়ের পরে আমাদের সরকার, আমাদের আদালত এক জন অপরাধীকে এ ভাবে ছেড়ে দিচ্ছে। আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, বিচার মিলবে...। কিন্তু কই, সুবিচার তো মিলল না!’’ নির্ভয়ার বাবা বদ্রীনাথও বলেন, ‘‘আমরা আর কী করতে পারি? এ লড়াই তো ছিল সমাজের জন্য।’’ আপাতত সুপ্রিম কোর্টে না গেলেও লড়াই তাঁরা থামাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন নির্ভয়ার বাবা-মা।

শুধু নির্ভয়ার বাবা-মা নন, উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁর এই ছেলেটিকে নিয়ে ত্রিবিধ উদ্বেগ রয়েছে সরকারের। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, কিশোর সংশোধন আবাসে থেকে নাবালকদের অপরাধী-মন যে সব সময় ভাল হয়ে যায় এমন নয়। ছেলেটির হাবভাব থেকে স্পষ্ট, সে ফের অপরাধ করতে পারে। দ্বিতীয়ত, তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল আক্রোশ রয়েছে। ফলে ছাড়া পাওয়ার পরে গণপিটুনির শিকার হতে পারে ছেলেটি। তাই মুক্তি পাওয়ার পরেও তাকে কোনও ‘সেফ হাউসে’ চোখে চোখে রাখতে হবে পুলিশকে। তার চেয়ে ওকে সংশোধনগারে রাখাই ভাল। তৃতীয়ত এবং সব থেকে বড় উদ্বেগের বিষয় হল, দিল্লির মজনু কি টিলায় যে সংশোধন আবাসে ছেলেটিকে রাখা হয়েছিল, সেখানে তার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় কাশ্মীরের একটি ছেলের। দিল্লি হাইকোর্টের বাইরে বিস্ফোরণের ঘটনায় জম্মু ও কাশ্মীরের ওই নাবালকটি অভিযুক্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের মতে, ওই জঙ্গি ছেলেটি নাবালক ধর্ষকের যথেষ্ট মগজ ধোলাই করেছে। নির্ভয়ার ধর্ষক তার কাশ্মীরি বন্ধুকে জানিয়েছে, মুক্তি পেলেই সে কাশ্মীরে যাবে। তাই তার উপর নজর রাখা প্রয়োজন। গত সপ্তাহে আদালতে সুব্রহ্মণ্যম স্বামীও বলেছিলেন, ‘‘সংশোধন হোমে এক অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাদীর সংস্পর্শে থেকে ছেলেটিও মৌলবাদী হয়ে গেছে।’’

আজ হাইকোর্টের বিচারপতিরা অবশ্য ধর্ষকের এই জঙ্গি-যোগের দিকটি আলাদা ভাবে উল্লেখ করেছেন। বিচারপতিদের বেঞ্চ বলেছে, যুবকটির বিরুদ্ধে মৌলবাদী হয়ে ওঠার অভিযোগ নিয়ে শুনানি চলবে। এ ব্যাপারে দিল্লি ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপোর্ট চেয়েছে হাইকোর্ট। পরের শুনানি ২৮ মার্চ।

নির্ভয়া-ধর্ষণে চার জন অভিষুক্ত— মুকেশ, বিনয়, পবন ও অক্ষয়কে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে। নিম্ন আদালতের দেওয়া এই শাস্তি দিল্লি হাইকোর্ট বহাল রাখার পরে তারা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। আর এক অভিযুক্ত, রাম সিংহ, ঘটনার তিন মাস পরে তিহাড় জেলের ভেতরেই আত্মহত্যা করে।

কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে নাবালক ছেলেটির বিচার করা যায়নি। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সরকার সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ না হলে বা মামলাটি অন্য দিকে মোড় না নিলে রবিবার মুক্তি পেতে চলেছে সে।

এখন অবশ্য তার বয়স একুশ ছুঁইছুঁই। এখন সে আর নাবালক নয়!

Delhi Gang rape Nirbhaya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy