দেশে জনধন অ্যাকাউন্ট আছে ৩৭ কোটি ৮৭ লক্ষ। তার মধ্যে ৮ কোটি অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃত, ফলে অকেজো। ফাইল চিত্র।
২০১৬ সালে, গ্রাহকের ১০ লক্ষ টাকার উপর বার্ষিক আয় হলে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এবং এটা যে সঠিক সিদ্ধান্ত তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ২০১৯ সালে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ৫ লক্ষ টাকার উপর আয় হলে আর ভর্তুকি না দেওয়ার সরকারি ভাবনাচিন্তার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কি না, তা কিন্তু জানা নেই।
তা হলে? সমস্যার জায়গাটা আরও বড়। অভিযোগ,সত্যিই যাঁদের এই ভর্তুকি প্রয়োজন, তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আগে সেই ভর্তুকি ঢুকলেও, এখন আয়ের সীমার নীচে থাকা অনেকেই তাঁদের প্রাপ্য পাচ্ছেন না। অর্থাৎ স্বচ্ছতার একটা অভাব থেকেই গিয়েছে। ২০১৯ সালে ৩৭ হাজার কোটি টাকার মতো পেট্রোলিয়ম ক্ষেত্রে ভর্তুকির চাপ ছিল কোষাগারের উপর। কিন্তু সরকার এই টাকা দিতে পারবে না তা কিন্তু কখনই বলেনি।
মেনে নেওয়া যাক ভর্তুকির এই সব সংবাদ নেহাতই ভুল। ধরে নেওয়া যাক সরাসরি ভর্তুকি দেওয়া হবেই। কিন্তু কী ভাবে? তার জন্য তো প্রাপকের অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। শুধু তাই নয়, তাঁকে তা ব্যবহার করতেও জানতে হবে! আগে দেখে নেওয়া যাক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি তথ্য।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যে দেখা যাচ্ছে— জনধন অ্যাকাউন্ট আছে ৩৭ কোটি ৮৭ লক্ষ। তার মধ্যে ৮ কোটি অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃতের তকমা পেয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মে নাকি দু’বছর ধরে কোনও অ্যাকউন্টে লেনদেন না হলে, তা অব্যবহৃতের তকমা পায়। তার মানে আট কোটি মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলেও ব্যবহার করেন না!
দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ সই করতে পারলেও, কোথায় সই করছেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফাইল চিত্র।
এঁরা তো যেখানে ব্যাঙ্ক আছে সেখানে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন কারণে তা ব্যবহার করছেন না। কেন? তার উত্তর কিন্তু স্পষ্ট নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরই সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫ লক্ষ ৯৭ হাজার ১৫৫টি গ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছিয়েছে। ২০১১ সালের সেনসাস বলছে, ভারতে মোট গ্রামের সংখ্যা ৬ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৮১টি। অর্থাৎ, ৫২ হাজারের উপর গ্রামে এখনও ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছিয়ে উঠতেই পারেনি। বিশ্বব্যাঙ্কের গ্লোবাল ফিনডেক্স সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ১৯ কোটি মানুষ ব্যাঙ্কিং পরিষেবার বাইরে ছিলেন ২০১৭ সালে।
ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ঘরের পাশে থাকলেই যে সবাই তা ব্যবহার করতে পারবেন তাও নয়। একটা বড় সংখ্যক মানুষই সই করতে পারলেও, কোথায় সই করছেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। প্রায় ২৮ কোটি মানুষ আমাদের দেশে নিরক্ষর। তাঁদের কাছে ব্যাঙ্কের খাতা কেন, ব্যাঙ্কের শাখায় ঢোকাটাই একটা বড় সাহসের পরিচয়।
তা হলে? সরাসরি ভর্তুকি সব থেকে সেরা উপায়। কিন্তু দিতে গেলে যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা দরকার, সে দিকে যতটা নজর দেওয়া দরকার তা না দিয়ে তার থেকেও আমরা তো বেশি ব্যস্ত রাজনৈতিক আকচাআকচিতে। যে দেশে ২৮ কোটি নিরক্ষর, আর তার বহুগুণ মানুষ ‘ব্যবহারিক নিরক্ষর’, সই করার বাইরে কোনও লেখা পড়ে তার মানে উদ্ধারে অক্ষম, সে দেশে সরাসরি ভর্তুকি ব্যবস্থা কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতির তত্ত্ব একে সমর্থন করলেও, তার সফল প্রয়োগের জন্য যে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও সহমর্মিতার প্রয়োজন তার অভাব কিন্তু সরকারী ব্যবহারের প্রতিটি পদক্ষেপে। গ্যাসের ভর্তুকি তো একটি উদাহরণ মাত্র। অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও সরকারের পদক্ষেপ নাগরিকের প্রতি কোষাগারের আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলার রাস্তার দিকই নির্দেশ করছে না তো এই নীতি পরিবর্তন? এই সংশয় কিন্তু ঝেড়ে ফেলা যাচ্ছে না মন থেকে।