আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তির মুখে ক্রমাগত মর্জিমাফিক যে শর্তগুলি দিচ্ছেন, সেগুলি আসলে দ্বিপাক্ষিক অর্থনীতি অথবা বাণিজ্য নিমিত্ত নয়। বরং সেখানে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যের সঙ্গে সংযোগহীন সব কারণই কাজ করছে। ভারতীয় পণ্যের উপর ট্রাম্প ঘোষিত ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কার পর এমনই মনে করছে সাউথ ব্লক। আর এই মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে প্রকাশ্য বাগযুদ্ধে না জড়িয়ে স্থৈর্য বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, ট্রাম্প কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সাউথ ব্লক সূত্রের বক্তব্য, কিছু জায়গায় সমস্যা থাকলেও ভারত-আমেরিকার বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট ইতিবাচক ভাবেই এগোচ্ছিল। আমেরিকার কৃষিপণ্য বা দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাস করার প্রশ্নে ভারত সায় দেয়নি ঠিকই, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সূত্র পাওয়া যেত। সূত্রের খবর, আমেরিকার যে বাণিজ্যকর্তারা ওতপ্রোত ভাবে এই দরদষাকষির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, তাঁরাই জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস থেকে রাজনৈতিক ছাড়পত্র আসছে না। ফলে অবস্থানের পরিবর্তন করতে হচ্ছে। জানা গিয়েছে, বিষয়টির জন্য নয়াদিল্লির কাছে দুঃখপ্রকাশও করেছেন তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে।
ট্রাম্প ভারত-আমেরিকা সম্পর্ককে এক ধাক্কায় আড়াই দশক আগের তিক্ততায় নিয়ে যেতে চাইছেন কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বার ত্রিশেক ভারত-পাকিস্তানের মধ্যস্থতার দাবি করলেও, ভারত সরকার আদৌ তাঁর দাবিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বিদেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে অস্বীকারও করা হয়েছে একাধিক বার। তাতে হতাশা, রাগ এবং তিক্ততা বেড়েছে ট্রাম্পের। অন্য অনেক দেশ যে ভাবে মাথা নিচু করে ফেলেছে, ভারত এখনও তা করেনি। রাশিয়ার থেকে তেল কেনা নিয়ে ট্রাম্পের হুমকির মাঝে আজও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কথা বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ডোভালের সঙ্গে পুতিনের বৈঠক ফলাও করে প্রচারও করা হয়েছে। দশ দিন পরে মস্কো যাবেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও।
সাধারণ ভাবে ট্রাম্পের সঙ্গে যারা দর কষাকষি করছে, তারা দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রথমটি হল বাংলাদেশ অথবা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র, যারা মাথা ঝুঁকিয়েই রয়েছে। আমেরিকার পণ্যে বিপুল ছাড় দিতে তারা রাজি। অন্য শ্রেণিতে চিন বা কানাডারমতো রাষ্ট্র যারা প্রকাশ্যেই বিবাদ করছে। ভারত মধ্যপন্থা নিয়ে চলছে, অর্থাৎ প্রকাশ্যে তিক্ত ভাষা ব্যবহারের মধ্যে যাচ্ছে না। আবার চাপেও মাথা নত করছে না। যা ট্রাম্পের হতাশার কারণ হতে পারে।
আপাতত মাথা ঠান্ডা করে পরিস্থিতির মোকাবিলায় বিভিন্ন পথের সন্ধান করা হচ্ছে। তার অন্যতম আমেরিকার মধ্যে ভারতের বন্ধু সংগঠন এবং সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগাযোগে থাকা। সেখানকার খুচরো ব্যবসায়ীদেরও বোঝানো যে ট্রাম্প শুল্কের এই দেওয়াল তুললে সে দেশেও মুদ্রাস্ফীতি তৈরি হতে পারে, আমেরিকার উপভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আমেরিকার রাজনৈতিক ভাবে স্পর্শকাতর কোটি কোটি ডলারের রফতানি পণ্যের তালিকাও তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার বাদাম, ওয়াশিংটনের আপেল, উইসকনসিনের মোটরবাইকের মতো পণ্য। ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তি ভেস্তে গেলে এই পণ্যগুলির উপরে বিপুল শুল্ক চাপানো হবে— এই চাপও কাজে লাগতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)