থমথমে আটালি গ্রামে পুলিশি টহল। ছবি: পিটিআই।
ভারতের রাজনীতিতে নির্বাচন আর সাম্প্রদায়িকতা আজও হাত ধরাধরি করে চলে। দিল্লি থেকে মাত্র ষাট কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার আটালি গ্রাম এই মুহূর্তে তার নয়া নমুনা। এই মুহূর্তে এখানে চলছে এক নতুন রামমন্দির বনাম বাবরি মসজিদ বিতর্ক। হরিয়ানায় পঞ্চায়েত নির্বাচন অগস্ট মাসে। অর্থাৎ দু’ মাস পরেই। আর এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ফরিদাবাদের কাছে এই গ্রামে স্থানীয় মুসলিমরা দাবি করেছেন, এখানকার নির্দিষ্ট একটি জমিতে তাঁরা মসজিদ বানাবেন। কারণ, ফরিদাবাদ আদালত দু’মাস আগেই রায় দিয়েছে, জমিটি মসজিদের জন্যই নির্ধারিত ওয়াকফ সম্পত্তি। ফলে ওখানে জাঠ জমিদারদের কোনও অধিকার নেই। কিন্তু এলাকায় সংখ্যায় বেশি জাঠেরা। তাঁরা লাঠি-সোঁটা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে গরিব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে মারধর করে গ্রামছাড়া করেছে।
ফরিদাবাদ ও লাগোয়া বল্লভগঢ়, দু’টি এলাকাতেই এখন বিজেপির বিধায়ক। কংগ্রেসের মুখপাত্র শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, গত লোকসভা নির্বাচনের সময় উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যেটা করেছিল, এমনকী, দিল্লিতে ভোটের সময় যা করার চেষ্টা হয়েছিল, হরিয়ানার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সেই মেরুকরণের রাজনীতিই শুরু করেছে তারা। স্থায়ীয় কংগ্রেস নেতাদের মতে, এই মেরুকরণের ফলে জাঠ ধনী কৃষকদের কাজে লাগিয়ে বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার বিপজ্জনক খেলা শুরু করেছে। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টার সঙ্ঘ পরিবারের পুরনো লোক। তিনি এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করছেন। তাঁর বক্তব্য, আসল বিতর্কটি জমি নিয়ে। এবং এই লড়াইটা ধনী বনাম দরিদ্র, তথা জোতদার বনাম গরিব চাষির। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কংগ্রেসের লোকেরাই বিজেপি-বিরোধিতার রাজনীতি করতে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলছে।
ফরিদাবাদ প্রাচীন জনপদ। শের শাহ যখন জি টি রোড বানিয়েছিলেন, তখন তা ফরিদাবাদ পর্যন্তই তৈরি হয়েছিল। শেখ ফরিদ ছিলেন জাহাঙ্গিরের কোষাধ্যক্ষ। তাঁর নামেই এলাকার নাম। যে হাসপাতালে আহতরা ভর্তি রয়েছেন, সেটির নাম বাদশা খান হাসপাতাল। আটালির জামা মসজিদের ইমাম বললেন, ‘‘এই এলাকাটি অতীতে মুসলিম অধ্যুষিত ছিল। ১৯৭৯ সালে এটি গুড়গাঁও থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে পাক উদ্বাস্তুদের ফরিদাবাদে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এখন এই আটালি গ্রামে দু’হাজার মানুষের মধ্যে মুসলিম পরিবার ২০০টি।’’
যে জমিটিকে ঘিরে বিতর্ক, ১৯৪৭ সালের রেকর্ড অনুযায়ী তা অতীতে ছিল কবরস্থান। সে কারণে পরবর্তী কালে সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে ধার্য হয়। জমিটির এক দিকে ছোট একটি মন্দির আছে। সঙ্কটমোচন হনুমানের মন্দির। শিব, কৃষ্ণ ও অন্যান্য বিগ্রহও আছে। এরই কাছাকাছি ওয়াকফের জমিতে ছিল একটি মসজিদ। মুম্বই বিস্ফোরণের পর এই মসজিদটি ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তখন টিনের শেড দিয়ে একটি ছাউনি বানিয়ে স্থানীয় সংখ্যালঘু সমাজ ওখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করেন। তেমনটাই চলছিল। এরই মধ্যে স্থানীয় দুই জাঠ প্রতিনিধি সতীশ কুমার ও যোগেন্দ্র আদালতে যান। তখন কংগ্রেস জমানা। আদালতে গিয়ে তাঁরা দাবি করেন, ওখানে আর কোনও মসজিদ বানানো চলবে না।
২০১০ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় স্থানীয় মুসলিমরা দাবি করেন, তাঁরা ওখানে বড় জামা মসজিদ বানাবেন। আপত্তি তোলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। তাঁদের যুক্তি, ওখানে বড় মসজিদ হলে মন্দির ঢাকা পড়ে যাবে। ২০১০ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায় এই মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নিয়ে।
এখন আর এক পঞ্চায়েত নির্বাচন আসতেই ফের উত্তাপ ছড়িয়েছে একই বিতর্ক। যার জেরে সংঘর্ষ শুরু হয় গত ২৬ মে। ১৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ৪টি গাড়ি ও ১৫টি মোটর সাইকেল পুড়ে ছাই। ৪ জন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। হরিয়ানা পুলিশ প্রায় ২ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। সংখ্যালঘু নিগৃহীত পরিবারগুলিকে আপাতত বল্লভগঢ়ের পুলিশ থানায় থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এই সব সন্ত্রস্ত্র মানুষকে রবারের মতো শক্ত শক্ত রুটি আর বেসনের তৈরি ‘করী’ পরিবেশন করছে হরিয়ানা সরকার। চামড়া ঝলসানো গরমের মধ্যে গাছতলায় বসে জাফর মিয়াঁ সেই রুটি দাঁত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছেন। খাওয়া কঠিন। কিন্তু পেটে যে খিদে!
আর জমিটি এখন রয়েছে পুলিশি নিরাপত্তার বেষ্টনীতে। আটালি গ্রামের পাশেই মেওয়াট। অতীতে যা ছিল ‘প্রিন্সলি স্টেট’। ব্রিটিশ জমানায় রাজার অধীনে থাকা এই এলাকা এখন রাজস্থান ও হরিয়ানায় ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। হরিয়ানার মেওয়াট এলাকাটি সম্পূর্ণ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। এলাকার সংখ্যালঘু সমাজ রাজপুত মুসলমানদের নিয়ে। ফলে এঁদের নামগুলোও খুব চিত্তাকর্ষক। এ রকমই এক ব্যক্তি রামপ্রসাদ খান বললেন, ‘‘আটালির সমস্যা না মিটলে আমাদের এলাকাতেও তার প্রভাব পড়তে পারে।’’ শিক্ষিত এই রাজপুত মুসলমান জানান, এই এলাকার মানুষ কিন্তু খুব একটা গোঁড়া ধর্মান্ধ নন। ভোটে ঠিক কী ভাবে তাঁরা সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তা স্পষ্ট নয়। এই এলাকায় আবার হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালার দল আইএনএলডি-র প্রভাব আছে। কংগ্রেসের আশঙ্কা, মেরুকরণের রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠলে হরিয়ানার সংখ্যালঘু মানুষের ভোট যদি চৌটালার দল ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়, তা হলে লাভের গুড় খাবে বিজেপি। সেটাও এক বড় সমস্যা রাহুল গাঁধীর সামনে।
তবে নয়াদিল্লি থেকে মাত্র ষাট কিলোমিটার দূরে এক সপ্তাহ ধরে যা সব ঘটে চলেছে, সে ব্যাপারে দিল্লিতে কিন্তু কোনও তাপ-উত্তাপ নেই।
একেই কি বলে প্রদীপের নীচে অন্ধকার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy