Advertisement
E-Paper

ভাগের পরেও ভারতে

তেরাত্তির কাটতেই বদলে গিয়েছিল ছবিটা। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তেরঙ্গা উঠল সব জায়গায়। কিন্তু র‌্যাডক্লিফ লাইনের আঁচড়ে মুর্শিদাবাদ, ২৪ পরগনা, নদিয়া, দিনাজপুর, মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকা বাদ রইল।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৬ ০১:৩৪

তেরাত্তির কাটতেই বদলে গিয়েছিল ছবিটা।

১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট তেরঙ্গা উঠল সব জায়গায়। কিন্তু র‌্যাডক্লিফ লাইনের আঁচড়ে মুর্শিদাবাদ, ২৪ পরগনা, নদিয়া, দিনাজপুর, মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকা বাদ রইল।

স্বাধীনতার ঝান্ডা ওড়ানোর যখন তোড়জোড় চলছে, ঠিক তার আগের দিন রে়ডিওয় ঘোষণা করা হয়, ওই সব জেলার ভাগ্য আপাতত ঝুলে থাকছে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, ২৪ পরগনা আপাতত পূর্ব-পাকিস্তানের হাতে, অন্য দিকে খুলনা অস্থায়ী ভাবে ভারতের হাতে থাকছে। মানচিত্রের গোলমালেই নাকি এমন বন্দোবস্ত।

সে রাত্তিরটা এখনও ছেঁড়া-ছেঁড়া মনে পড়ে কৃষ্ণনগরের অশীতিপর বৃদ্ধ দেবকুমার গুপ্তের: ‘‘১৪ অগস্ট রাতে বাবা বাড়ি ফেরেননি। আমরা চার ভাই আর মা ছাদে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা কালেক্টরি অফিসে চাকরি করতেন। রাত ১২টার পরে ফিরলেন। বিধ্বস্ত।’’ দেবকুমার তখন দশ বছরের বালক। ‘‘আমরা তখন ছোট, তত কিছু বুঝি না। বাবা খেতে বসে মাকে বললেন— ইন্ডিয়ায় থাকতে হলে চাকরি ছাড়তে হবে। রাতে ঘুমোতে পারেননি। বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সকাল হতেই ফের বেরিয়ে গেলেন।’’

সেই সকালটা ১৫ অগস্টের।

তার আগেই মধ্যরাতে দিল্লিতে জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতায় যুগাবসান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অন্য ছবি নদিয়া-মুর্শিদাবাদে। কৃষ্ণনগর ও চাকদহে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা তোলা হয়। বহরমপুরের স্কোয়ার ফিল্ডে মধ্যরাতেই পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়ে।

‘‘১৫ অগস্ট সকালেই কৃষ্ণনগর শহরের কদমতলা ঘাট থেকে আমাদের দেবনাথ হাইস্কুলের মৌলবি সাহেবকে রিকশায় বসিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মিছিল করা হয়। সিনেমা হাউস লেনে চিত্তমন্দির সিনেমা হলের (এখন আর নেই) সামনে বিশাল তোরণও বানানো হয়েছিল। গোটা শহর থমথমে। বিকেলে টাউন হলের মাঠে সর্বদলীয় সভা হয়। সেখান থেকে ভারতভুক্তির আর্জি ওঠে’’— বলে চলেন দেবকুমার।

ইতিমধ্যে রটে যায়, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মহারানি জ্যোতির্ময়ী আক্রান্ত হতে পারেন। তা শুনে ১৮ অগস্ট সকালে মায়াপুর ও বাহাদুরপুর থেকে বহু লোকজন জলঙ্গির ও পারে এসে জড়ো হন। পুলিশ তাঁদের আটকায়। পরে সোনাডাঙার মাঠে জমায়েতে এসে রাজা সৌরীশচন্দ্র রায় তাঁদের আশ্বস্ত করেন যে, মহারানি নিরাপদ আছেন। বলতে-বলতেই হেসে ফেলে দেবকুমার বলেন, ‘‘ওই দিনই অবশ্য জানা যায় যে কৃষ্ণনগর-সহ নদিয়ার বেশির ভাগ এলাকা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়াতেই ফিরে যাচ্ছে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি থেকে কামান দাগা হয়।’’


১৯ অগস্ট, ১৯৪৭ আনন্দবাজার পত্রিকা।
সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

সব জায়গাতেই এমন অস্বস্তি কাজ করছিল তা অবশ্য নয়। বহরমপুরের স্কোয়ার ফিল্ডে পাকিস্তানের পতাকা তুলে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা নেতা সুধীন সেন স্বরচিত গান ধরেন, ‘‘সোনার দেশে গড়ব মোরা স্বাধীন পাকিস্তান, সুখ-
শান্তি আনব মিলে হিন্দু-মুসলমান।’’ কমিউনিস্ট পার্টি তখন নীতিগত ভাবে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলছিল।

কিন্তু সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের অগ্রদূত রেজাউল করিম ও মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর, অসাম্প্রদায়িকতার অন্যতম উদ্গাতা ওয়াসেফ আলি মির্জা এই জেলার পাকিস্তানভুক্তির, এমনকী দ্বিজাতি তত্ত্বেরও বিরোধী ছিলেন। লালবাগের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক, নব্বই ছুঁই-ছুঁই রামপ্রসাদ পাল তখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তাঁর কথায়, ‘‘স্পষ্ট মনে আছে, স্বাধীনতার বছর দুয়েক আগে হাজারদুয়ারি ও ইমামবাড়ার মাঝে মাঠে ‘হিন্দু-মুসলিম কমিউনিটি কনফারেন্স’ নামে বিশাল সম্মেলন হয়েছিল। তা বানচাল করার চেষ্টা করেছিলেন ওয়াসেফ আলি মির্জার ছেলে, মুসলিম লিগের নেতা নবাব বাহাদুর কাজেম আলি মির্জা। নবাব বাহাদুরের বাধায় পেরে ওঠেননি।’’

দৌলতাবাদের নওদাপাড়া গ্রামের সদ্যপ্রয়াত আমিনা বেওয়া কিছু দিন আগেও বলে বেড়াতেন সেই সব দিনের গল্প। ভৈরবের পশ্চিম পাড়ের নওদাপাড়ায় তখন মুসলিমদের বাস। পুবপাড়ে চক-ইসলামপুরে আবার সব হিন্দু। আমিনার মনে পড়ত— ‘‘ওই তিন দিন চক ইসলামপুরের মানুষ আতঙ্কে ঘরের দরজা খোলেননি। অন্য সম্প্রদায়ের এক দল যুবক কাঁধে লাঠি টাঙিয়ে সুর করে ‘হাতে লাঠি, মুখে পান, লাঠির ডগায় পাকিস্তান’ গেয়ে সেখানকার বিভিন্ন বাড়িতে ঢ্যাঁড়া আঁকত দখল করার জন্য।’’

করিমপুরের বিরাশি বছরের ফটিক মণ্ডলের বয়স তখন বছর তেরো। ‘‘এখনকার বাংলাদেশের বাওয়ান গোপালপুরে আমাদের বাড়ি ছিল। ক’দিন থেকেই বড়দের মুখে শুনছি, দেশ স্বাধীন হবে। টেলিফোন দূরের কথা, গ্রামে তখন রেডিও-ও ছিল না। শুনলাম, কাছেই একটা নদী হয়েছে দুই দেশের সীমান্ত। বুঝতে পারছিলাম না, পাশের হিলসি নদী নাকি মাথাভাঙা। বাড়িঘর ভেঙে বাবা চলে সবাইকে নিয়ে এলেন সীমান্তের কাছারিপাড়ায়।’’ ১৫ অগস্ট কিন্তু তাঁরা জানলেন, ইন্ডিয়া নয়, তাঁরা রয়ে গিয়েছেন পাকিস্তানেই। কাছেই শিকারপুর ও অন্য কয়েকটি জায়গায় পাকিস্তানের পতাকাও তোলা হয়েছে। তিন দিন পরে জানা গেল, মাথাভাঙা নদীই সীমান্ত। তাঁরা ভারতে। ‘‘সে দিন আনন্দে সারারাত ঘুমায়নি বহু মানুষ। আমি ছোট ছিলাম। মনে হয়, ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”

আজও সেই তিনটি দিন ভুলতে পারেননি জেলার পুরনো মানুষেরা। স্বাধীনতা দিবসের সমান মর্যাদায় তাঁরা দিনটি পালন করেন। বৃহস্পতিবার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাসে প্রভাতফেরি হয়। পরে তোলা হয় জাতীয় পতাকা। রানাঘাটেও দিনটি উদ্‌যাপিত হয়েছে।

অলঙ্করণ: বিমল দাস ও প্রবাল ধর

Rakhi celebration
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy