Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষোভ, আশঙ্কা...তবু যেন হওয়ারই ছিল

আগামী দিনে শীর্ষ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারের দিকে কেন্দ্রের হাত বাড়ানো নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। 

উর্জিত পটেল।ছবি: পিটিআই

উর্জিত পটেল।ছবি: পিটিআই

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৩৭
Share: Save:

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ক্ষুব্ধ। বিরক্তও।

আগামী দিনে শীর্ষ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারের দিকে কেন্দ্রের হাত বাড়ানো নিয়ে যারপরনাই শঙ্কিত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।

প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম দুঃখিত। একই অভিব্যক্তি এক সময়ে তাঁর মুখ্য উপদেষ্টা কৌশিক বসুরও।

দিল্লি থেকে মার্কিন মুলুক, অর্থনীতিবিদ থেকে শিল্প মহল— রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষ পদ থেকে উর্জিত পটেলের এ ভাবে সরে যাওয়া নিয়ে ক্ষোভ, আশঙ্কা, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে হতাশার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে সব জায়গাতেই। কিন্তু অন্তত একটি ব্যাপারে সকলে এক মত, তা হল অক্টোবরে ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্যের বিস্ফোরক বক্তৃতার পরে পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছিল, তাতে এই দেওয়াল লিখন আগে থেকেই পড়া যাচ্ছিল স্পষ্ট। কেউ কেউ বলছেন, ১৯ নভেম্বর, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গত বোর্ড বৈঠকের দিন মতের অমিলের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়তো হয়েছিল, কিন্তু তার পরেও ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছিল কেন্দ্র। তাই এই সিদ্ধান্ত যেন কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিছক সময়ের অপেক্ষা।

আরও পড়ুন: ‘স্বাধীনতা’র সংগ্রামে ইতি, ইস্তফা উর্জিতের

অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি কিংবা শীর্ষ ব্যাঙ্কের সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ ডিরেক্টর এস গুরুমূর্তি সোমবার যতই পটেলের প্রশংসা করুন না কেন, শিল্প-ব্যাঙ্কিং মহল এবং পড়াশোনার জগতের জিজ্ঞাসা, এত গুণী মানুষের কদর তা হলে এত দিন হল না কেন? কেনই বা উর্জিত ও তাঁর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বার বার বাধার দেওয়াল তোলা সত্ত্বেও শীর্ষ ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারের ভাগ পেতে এত মরিয়া হয়ে উঠল কেন্দ্র? স্বাধীকারে হস্তক্ষেপ জেনেও মোদী সরকার পিছপা হল না রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিতর্কিত ৭ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে ‘পরামর্শ’ দিতে? তাই অনেকেরই প্রশ্ন, ১৪ ডিসেম্বরের বোর্ড বৈঠকে এই চাপ আরও বাড়বে আঁচ করেই কি শেষমেশ সরে দাঁড়ালেন উর্জিত?

সাম্প্রতিক সংঘাত

• ২৬ অক্টোবর, ১৮: রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্যের বিস্ফোরক বক্তৃতা। বললেন, ‘‘যে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের স্বাধীনতাকে মর্যাদা দেয় না, আজ হোক বা কাল তারা দেশের আর্থিক বাজারের রোষের আঁচ টের পাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্ব নষ্ট করার জন্য এক দিন তীব্র অনুশোচনায় ভুগতে হবে তাদের।’’ প্রায় সকলেই বললেন, উর্জিতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া সম্ভবত এত বড় লড়াইয়ে নামতেন না বিরল।

• ২৭ অক্টোবর, ১৮: পরের দিনই পাল্টা জেটলির। বললেন, ‘‘ভারতের অর্থনীতি যেহেতু দ্রুত বদলাচ্ছে, তাই সমস্ত নিয়ন্ত্রণই নমনীয় হওয়া জরুরি। বাস্তব মাথায় রেখে নিয়ন্ত্রণ নীতিতে প্রয়োজনীয় বদল আনা জরুরি।’’

• ৯ নভেম্বর, ১৮: আর্থিক বিষয়ক সচিব সুভাষচন্দ্র গর্গের দাবি, শীর্ষ ব্যাঙ্ককে আদৌ কোনও টাকা সরকারি কোষাগারে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। তবে তাদের ভাঁড়ারের টাকার কতটা কোষাগারে পাঠানো উচিত, সেই নিয়মে বদল চান তাঁরা।
এর পরেও ঠারেঠোরে এই একই বার্তা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আমলারা।

আগেও অভিমানী

• মার্চ, ১৮: উর্জিত জানালেন, ‘স্বচ্ছ ব্যাঙ্ক’ অভিযানে (দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে) যদি তাঁদের নীলকণ্ঠও হতে হয়, তবে তাঁরা সেই বিষ পানে রাজি!
• জুন, ১৮: অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সামনে উর্জিত পটেল নাকি বলেন যে, অনাদায়ি ঋণ থেকে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি— পান থেকে চুন খসলেই আঙুল ওঠে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দিকে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য হাতে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়াই হয়নি তাকে। তাই আঁটোসাটো নজরদারি চাইলে, আগে হাতে ক্ষমতা দেওয়া জরুরি।
অর্থ মন্ত্রকের পাল্টা প্রশ্ন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত ক্ষমতা না থাকার কথা পটেল বলছেন। কিন্তু বেসরকারি ব্যাঙ্কে তো সেই সমস্যা নেই। তাহলে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কে কেলেঙ্কারি এড়ানো গেল না কেন?

ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ বি কে দত্ত যেমন বলছেন, ‘‘ভাঁড়ারের একটা অংশ কেন্দ্রের হাতে তুলে দিতে যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল, তা মানতে পারেননি উর্জিত।... আমি মনে করি, ভোটের মুখে রাজনৈতিক স্বার্থেই ওই টাকা পেতে চায় কেন্দ্র। উর্জিত তাতে নারাজ।’’ তাঁর দাবি, এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে, উর্জিতকে চলে যেতে হবে। কারণ, কেন্দ্র যে ভাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতায় ক্রমাগত নাক গলাচ্ছিল, তা যে কোনও গভর্নরের পক্ষেই মানা কঠিন। রঘুরাম রাজন পারেননি। উর্জিতও পারলেন না।

শিল্প প্রতিনিধিদের আবার আশঙ্কা, উর্জিতের এই ঘোষণায় অস্থিরতা তৈরি হবে বাজারে। একই আশঙ্কা অর্থনীতির শিক্ষকদেরও। বণিকসভা সিআইআইয়ের জাতীয় কমিটির সদস্য তথা পূর্বাঞ্চলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ও ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের মতে, প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি (এফডিআই) ও বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থা (এফআইআই) কোথাও পা রাখার আগে সেখানকার বাজারে স্থিরতা খোঁজে। দীপঙ্করবাবু বলেন, ‘‘রাজন তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধিতে সায় দেননি। মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টার পদ থেকে অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন সরে দাঁড়িয়েছেন। এখন উর্জিতও ইস্তফা দিলেন। এ সবই অস্থিরতার বার্তা দেয়।’’ অভিরূপবাবুর আশঙ্কা, ‘‘এই অস্থিরতায় এফআইআই ভারত থেকে লগ্নি তুলে নিলে ডলারের সাপেক্ষে টাকা আরও দুর্বল হতে পারে।’’

কেন্দ্র-আরবিআইয়ের বিরোধে শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তাই আইআইএম কলকাতার অর্থনীতির অধ্যাপক পার্থ রায় মনে করেন, বিশ্বকে সদর্থক বার্তা দিতে দ্রুত পরের গভর্নরের নাম ঘোষণা করা জরুরি। কিন্তু দেখতে হবে আরবিআইয়ের স্বাধীনতা যেন বজায় থাকে। কিন্তু সে ব্যাপারেও সন্দিহান অভিরূপবাবুর আশঙ্কা, ‘‘শীর্ষ ব্যাঙ্কের পরিচালন পর্ষদে সরকারি প্রতিনিধি রয়েছেন। তাই গভর্নর পদেও নিজেদের পছন্দের কাউকে বসানো সহজ হবে কেন্দ্রের।’’ সেই চেষ্টা যে একেবারে হবে না, তা হলফ করে বলতে পারছেন না কেউই।

আরও পড়ুন: মাল্যের প্রত্যর্পণে সায় ব্রিটিশ কোর্টের, বড় জয় বললেন জেটলি

বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর বলে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্তারা। কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের প্রাক্তন সিএমডি দেবব্রত সরকার বলছেন, এই সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। পটেলের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অবশ্য অবাক করেছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক কর্মীদের। এ জন্য কেন্দ্রের দিকেই আঙুল তুলেছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE