Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

নিজের অ্যাকাউন্টে নোট জমাতেও লাগবে জবাবদিহি

৮ নভেম্বর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার সময়ে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, পুরনো নোট ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া যাবে এবং ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৪০০০ টাকা অবধি পুরনো নোট পাল্টে নতুন নোট নেওয়া যাবে।

‘তাড়াহুড়ো কীসের!’ ছিল সরকারি বিজ্ঞাপনেই।

‘তাড়াহুড়ো কীসের!’ ছিল সরকারি বিজ্ঞাপনেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

আবার কথা রাখলেন না নরেন্দ্র মোদী!

৮ নভেম্বর ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার সময়ে প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, পুরনো নোট ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া যাবে এবং ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৪০০০ টাকা অবধি পুরনো নোট পাল্টে নতুন নোট নেওয়া যাবে। পরে নোট বদলানোর ওই সীমা বাড়ানো হবে। সেই সব আশ্বাসে যাঁরা আস্থা রেখেছিলেন, তাঁরা আজ হাত কামড়াচ্ছেন।

নোট বদলের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর বদলে তা কমিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরোপুরিই বন্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর আজ নিজের অ্যাকাউন্টে পুরনো নোট জমার উপরেও জারি হলো বিধিনিষেধ। নিজের টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিজের ইচ্ছামতো জমা দেওয়ার আর জো রইল না!

পুরনো নোট নাকচের সময় টাকা তোলার পরিমাণও বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্র। তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, এই ঘটনা নোট ও ব্যাঙ্ক অর্থনীতির উপরে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত। আর এ বার নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়ার উপরে যে ভাবে রাশ টানা হলো, সেটা যে কার্যত নজিরবিহীন, তা মানছেন প্রায় সকলেই।

অথচ, কালো টাকার কারবারি যাঁরা নন, সেই আমজনতাকে যে নোট বাতিল নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না তা বোঝাতে গিয়ে নভেম্বরের ৮ তারিখ মোদী বলেছিলেন, ‘‘অচল নোট জমা দেওয়ার জন্য ৫০ দিন সময় রয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খুশি নোট জমা করতে পারবেন। কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না। আপনার টাকা আপনারই থাকবে। চিন্তার কিছু নেই।’’ এর পর আর এক প্রস্ত আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। নোট বাতিলের পরে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে যখন উপচে পড়া ভিড়, তখন জেটলির মন্তব্য ছিল, ‘‘এখনই সকলের একসঙ্গে ব্যাঙ্কে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর দরকার নেই। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে।’’

সেই আশ্বাস খারিজ করে এ দিনই কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছে, মঙ্গলবার থেকে ৫০০০ টাকার বেশি অচল নোট জমা দেওয়া যাবে মাত্র এক বারই। এবং তা-ও কড়া নজরদারির মধ্যে। দু’জন ব্যাঙ্ক অফিসারের সামনে লিখিত ভাবে জবাবদিহি করতে হবে, কোথা থেকে এই টাকা এল, কেন এত দিন তা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়া হয়নি। অর্থ মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তি বলছে, ব্যাখ্যায় অফিসারেরা সন্তুষ্ট হলে তাঁরা গ্রাহকের লিখিত বয়ানের উপরে সই করবেন। তার পর টাকা অ্যাকাউন্টে জমা করা যাবে। যদি ব্যাখ্যা অফিসারদের সন্তুষ্ট না হন, তা হলে কি টাকা জমা করাই যাবে না? ব্যাখ্যা দেয়নি অর্থ মন্ত্রক। রাতে জেটলি অবশ্য বলেছেন, এক বার পুরনো নোট জমা দিলে কোনও জবাবদিহি করতে হবে না। বারবার টাকা জমা দিতে গেলেই কড়াকড়ি করা হবে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলির তরফে বলা হচ্ছে, তাঁদের কাছে এমন কোনও ‘ছাড়ের’ নির্দেশিকা নেই। তাঁদের বলা হয়েছে, প্রথম বার জমার অঙ্ক ৫০০০ ছাড়ালেই প্রশ্ন করতে।

এখন প্রশ্ন হলো, আইনি পথে আয় করা এবং আয়কর মেটানো টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য এত বিধিনিষেধ ও জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে কেন? কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, ব্যাঙ্কে অকারণ লাইন কমাতেই এই দাওয়াই। অর্থ মন্ত্রক চাইছে, যাঁদের কাছে এখনও অচল নোট রয়ে গিয়েছে, তা তাঁরা একবারে জমা করে দিন। জেটলির কথায়, ‘‘কোনও এক জন ব্যক্তি যদি প্রতিদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে কিছু কিছু করে পুরনো নোট জমা করেন, তা হলে সন্দেহ তৈরি হয় যে তিনি কোথাও থেকে এই টাকাটা পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে প্রশ্নের মুখে পড়তেই হবে। তাই আমাদের পরামর্শ, যাঁর কাছে যা পুরনো নোট আছে এক বারে ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা দিন।’’

কিন্তু অনেক গৃহস্থই খারাপ সময়ের কথা ভেবে বাড়িতে নগদ টাকা জমিয়ে রাখেন। এখন এক বার টাকা জমা দেওয়ার পর যদি আলমারি বা সিন্দুকের কোনও কোণ থেকে আবার কিছু টাকা বেরোয়, তা হলে তো ব্যাঙ্কে গিয়ে ফের হেনস্থা হতে হবে। আবার অনেকেই নিরাপত্তার কারণে একসঙ্গে অনেক টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন না। বিপাকে পড়বেন তাঁরাও। তখন সবটাই নির্ভর করবে, যে দুই ব্যাঙ্ক অফিসার জবাবদিহি নেবেন তাঁদের মর্জির উপরে।

পুরনো নোটে ৫০০০ টাকার কম জমা করতে গেলে আপাত ভাবে কোনও হেনস্থায় পড়তে হবে না। কিন্তু তাই বলে বারবার ব্যাঙ্কে গিয়ে কম পরিমাণ টাকা জমাও করা যাবে না। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, মোট জমার পরিমাণ ৫০০০ ছাড়িয়ে গেলেই জবাবদিহি করতে হবে। তা ছাড়া, কেওয়াইসি তথ্য দেওয়া নেই এমন অ্যাকাউন্টে ৫০ হাজার টাকার বেশি জমা দেওয়াও যাবে না।

প্রশ্ন আরও আছে। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস মতো ৩০ ডিসেম্বরের পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গিয়ে কি টাকা পাল্টানো যাবে? নাকি সেই প্রতিশ্রুতি থেকেও পিছিয়ে আসছে মোদী সরকার? অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের কাছ থেকে আজ অন্তত এই প্রশ্নের জবাব মেলেনি।

কিন্তু নোট জমা নিয়ে হঠাৎ কেন এমন ফরমান জারি করল অর্থ মন্ত্রক?

মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এত দিন কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো নোট ব্যবহারের উপরে ছাড় ছিল। এখন সেই সব ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষের আর পুরনো নোট ঘরে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে গেলে কেন ব্যাঙ্কের অফিসারদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে, সেই প্রশ্নের জবাব মিলছে না।

নোট বাতিলের ঘোষণার পর থেকেই যে ভাবে বারবার নিয়ম বদল হচ্ছে, তা দেখে মোদী সরকারের পরিকল্পনার অভাবের অভিযোগও উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, কেউ এখনও টাকা জমা করেননি মানেই তাঁর কাছে কালো টাকা রয়েছে বলে কেন ধরে নিচ্ছে মোদী সরকার! রাহুল গাঁধী আজ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরে জনসভায় অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘গরিব থেকে কৃষক, শ্রমিক থেকে গৃহবধূ, সকলকেই নরেন্দ্র মোদী চোর বলছেন। সেই মানসিকতা থেকেই একের পর এক ফরমান জারি করছেন তিনি।’’ কংগ্রেসের অভিযোগ, বারবার ডিগবাজি খাচ্ছে অর্থ মন্ত্রক।

অর্থ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে নয়া নির্দেশিকার আরও একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এমনিতেই ইতিমধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক জাল নোট জমা পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এখন টাকা জমার শেষ বেলায় ভিড়ের মধ্যে জাল নোট জমা পড়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিস্তর। তাই এই কড়াকড়ি।

ঘটনা হল, ৮ নভেম্বরের আগে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটে প্রায় ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা বাজারে ছিল। সরকার আশা করেছিল, এর একটা বড় অংশই জমা পড়বে না। কালো টাকার মালিকরা অচল নোট নষ্ট করে ফেলবেন। কিন্তু ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার শেষ সীমার দিন দশেক আগেই প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা ফেরত চলে এসেছে। এর পর ৩১ মার্চ পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কে টাকা বদল করা যাবে বলে সরকারের ঘোষণা এখনও বহাল। ফলে সব মিলিয়ে যদি পুরনো নোটের প্রায় সবটাই ফেরত চলে আসে, তা হলে আমজনতাকে বিপাকে ফেলে, অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলে নোট বাতিলে আখেরে লাভ কী হল, সেই প্রশ্ন উঠবে। অনেকের মতে, মুখে চুনকালি পড়া ঠেকাতেই শেষ পর্বে টাকা জমা দেওয়ার উপরে কড়াকড়ি করতে চাইছে সরকার। যাতে বাতিল নোট পুরোটা ঘরে না ফেরে।

কিন্তু এত করেও মুখরক্ষা হবে কি? সংশয় ক্রমেই বাড়ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE