হাসপাতালের সামনে রাহুল। ছবি: পিটিআই। ইনসেটে আত্মঘাতী সেই জওয়ান।
উত্তাল হয়ে উঠল দিল্লি। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর থেকে দিল্লির রাজপথে বিরোধীদের এত বড় উপস্থিতি আর দেখা যায়নি। পেনশন বঞ্চনার অভিযোগ তুলে এক প্রাক্তন সেনাকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বুধবার এই রকম উত্তাল হয়ে উঠল দিল্লি। কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে কিছুতেই মৃতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দিল না কেন্দ্র। রাহুল সহ কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বকে দু’বার আটক করল দিল্লি পুলিশ। লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতাল থেকে বেরনোর পথে মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবালের পথ আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে গাড়ির মধ্যেই আটকে রাখা হল। সব মিলিয়ে রাজধানীর রাজনীতি অগ্নিগর্ভ হয়ে রইল দিনভর।
কম পেনশন আর ‘এক পদ, এক পেনশন’-এ (ওআরওপি) বর্ধিত অর্থ না পাওয়ার অভিযোগে দিল্লিতে আত্মহত্যা করেছেন এক প্রাক্তন জওয়ান। ঘটনার সূত্রপাত সেই আত্মহত্যাকে ঘিরেই। হরিয়ানায় রামকিষাণ গ্রেবাল নামে এক প্রাক্তন জওয়ান দু’দিন আগেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকরকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেন, তিনি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নে প্রায় ৭ বছর ও পরে ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ বছরের বেশি সশস্ত্র বাহিনীর হয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু দু’জায়গায় কাজ করে তাঁর পেনশন কম। আর ওআরওপি-র বর্ধিত টাকাও পান না। এই চিঠি লেখার মাত্র দু’দিনের মাথায় তিনি দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রকের দফতরের সামনে আত্মহত্যা করলেন।
এই খবর চাউর হতেই ময়দানে নেমে পড়েন রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরীবালরা। মৃত প্রাক্তন সেনাকর্মীর দেহ প্রথমে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে রাখা ছিল। মৃতের পরিজনরাও সেখানেই ছিলেন। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া সেখানে দেখা করতে গেলে পুলিশ তাঁর পথ আটকায়। তাঁকে আটক করা হয়। এর পর লোহিয়া হাসপাতালে পৌঁছন রাহুল গাঁধী। রাহুলকে বাধা দেয় দিল্লি পুলিশ। তাঁকে আটকও করা হয়। রাহুলকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দির মার্গ থানায়। সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখার পর, রাহুলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের বক্তব্য, হাসপাতাল রাজনীতি করার জায়গা নয়। সে কারণেই নেতাদের আটক করা হয়েছে
এতেই কিন্তু থামেনি দিল্লির তরজা। মৃতের ছেলেকেও এ দিন দিল্লি পুলিশ আটক করে। প্রথমে সেই খবর চেপে যায় পুলিশ। ময়না তদন্তের জন্য রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতালে। মৃতের পরিজনদের সঙ্গে দেখা করতে সেখানে পৌঁছন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। তাঁকেও হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় তাঁকে আটকানো হচ্ছে, কেজরীবালকে দিল্লি পুলিশ এমনই জানায়। এর পর কেজরীবাল জানতে পারেন, মৃত প্রাক্তন সেনাকর্মীর ছেলেক কনট প্লেস থানায় আটকে রেখেছে পুলিশ। এ খবর পেয়ে তিনি লেডি হার্ডিঞ্জ হাসপাতাল থেকে কনট প্লেস থানার উদ্দেশে রওনা দিতেই, পুলিশ তাঁর পথ আটকায়। ঘিরে ফেলা হয় কেজরীবালের গাড়ি। সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয় কনভয়। মৃতের ছেলের সঙ্গে কেজরীবালের দেখা হওয়া আটকাতে যখন পুলিশের এই রকম নজিরবিহীন কার্যকলাপ চালাচ্ছে, তখন গোটা দিল্লিতেই সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস নেতৃত্ব পৌঁছন কনট প্লেসে। কিন্তু থানায় ঢোকার আগেই তাঁদের আটক করা হয়। রাহুল গাঁধী ছাড়াও গুলাম নবি আজাদ, শীলা দীক্ষিত, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, অজয় মাকেন, রণদীপ সুরজেওয়ালা সহ কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাট অংশকে আটক করে নেয় পুলিশ। সন্ধ্যা ৭টার পর তাঁদের তিলক মার্গ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বুধবার দুপুরে যখন রাহুল গাঁধীকে প্রথম বার আটক করা হয়েছিল, তখন থানায় বসে পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন কংগ্রেস সহ সভাপতি। সেনার সাফল্যকে হাতিয়ার করে মোদী গত এক মাস ধরে যে রাজনীতি করছেন, তার পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেন রাহল।থানায় বসেই কংগ্রেস নেতারা রাহুলের সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটির ভিডিও রেকর্ডিং করেন। সেখানে রাহুলকে বলতে শোনা যায়, ‘‘শহিদের পরিবারকে কী করে গ্রেফতার করা হচ্ছে? তাঁদের গ্রেফতার করা হলে আমাকেও গ্রেফতার করুন।’’
রাহুল বাইরে বলেন, ‘‘এ এক নতুন ভারত। পুরোদস্তুর অগণতান্ত্রিক।’’ অরবিন্দ কেজরীবালও বলেন, ‘‘এত দিন ধরে গোটা দেশ ঘুরে প্রধানমন্ত্রী বলে আসছিলেন ওআরওপি চালু হয়ে গিয়েছে। তার মানে তিনি দেশবাসীকে মিথ্যা বলে ছলনা করছিলেন।’’ যে সেনার জয়গান করে মোদী ভোট-যুদ্ধে ফায়দা তুলতে চেষ্টা করছেন, তাতে আঁচ পড়তে দেখে গোটা বিষয়টি দ্রুত খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সকালেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে মোদী বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পর্রীকর জানান, ‘‘এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়ে আমি রিপোর্ট চেয়েছি।’’ প্রাথমিকভাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, আত্মঘাতী জওয়ান ওআরওপির সুবিধা পাচ্ছিলেন। ১১,৩০০ টাকার মতো মূল পেনশন, তার উপর ১২৫ শতাংশ মহার্ঘভাতার সুবিধা পাচ্ছিলেন তিনি।
তা সত্ত্বেও এটি নিয়ে ‘রাজনীতি’ হচ্ছে দেখে এ বার আরও তেড়েফুঁড়ে নামতে চেয়েছে বিজেপি। প্রাক্তন সেনাপ্রধান ও মোদী সরকারের মন্ত্রী ভিকে সিংহ আত্মঘাতী প্রাক্তন জওয়ানের মানসিক অবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘‘তাঁর মানসিক অবস্থা কী ছিল, সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার। ওআরওপির বিষয়টি রাজনীতির বাইরে রাখা দরকার। রাহুল গাঁধীর দল চল্লিশ বছর ধরে ওআরওপি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ না করে চুপ করে বসেছিল। ফলে তাঁর এটি নিয়ে রাজনীতি সাজে না।’’ তবে ওআরওপি নিয়ে এখনও যে অনেক অসঙ্গতি আছে সেটি মানছেন তিনি। কমিটি সেগুলি খতিয়ে দেখছে বলে ক’দিন আগেই জানিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। অমিত শাহ ঘনিষ্ঠ বিজেপির সচিব শ্রীকান্ত শর্মা বলেন, ‘‘রাহুল গাঁধী অপেক্ষা করেন, কার কখন মৃত্যু হবে, যাতে তিনি রাজনীতি করতে পারেন। তিনি একজন নন-সিরিয়াস পার্ট টাইম রাজনীতিক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy