সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনে এক ধাপ এগোল নগদকাণ্ডে অভিযুক্ত বিচারপতি যশবন্ত বর্মাকে অপসারণের প্রক্রিয়া! সোমবার শাসক ও বিরোধী দলের মোট ২০০ জন সাংসদ অভিযুক্ত বিচারপতির ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করার আবেদনে সায় দিয়েছেন। বস্তুত বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই সংসদে বিচারপতিকে অপসারণের পথে কেন্দ্রের পদক্ষেপে সায় দিয়েছে বিরোধীদের বড় অংশ।
যদিও ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ভূমিকা’ নিয়ে শাসক এবং বিরোধী সাংসদদের তরজায় লোকসভার প্রথম দিনের অধিবেশন ২০ মিনিট পরেই মুলতুবি হয়ে গেল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবি মেনে ‘অপারেশন সিঁদুর' এবং সংঘর্ষবিরতি নিয়ে আলোচনায় রাজি হয়েছে সরকার। কিন্তু বিতর্কের জন্য ‘যৎসামান্য সময়’ বরাদ্দ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
কী বললেন প্রধানমন্ত্রী মোদী?
সোমবার বাদল অধিবেশনের প্রথম দিন কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে সঙ্গে নিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশ করার সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি বলেন, “গোটা বিশ্ব দেখেছে ভারতের সামরিক শক্তি।” ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে সংসদে শাসক এবং বিরোধীপক্ষ এক সুরে কথা বলবে বলে আশাপ্রকাশ করেন মোদী।
বাদল অধিবেশনের গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাফল্যের একাধিক খতিয়ান তুলে ধরেন। মোদী বলেন, “২২ মিনিটের মধ্যে জঙ্গিদের ডেরায় গিয়ে আঘাত করেছে ভারত। সেনাশক্তির এটা ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ রূপ। ভারতে তৈরি অস্ত্রের উপর বাকি বিশ্বের ভরসা বাড়ছে।” শুভাংশু শুক্লদের মহাকাশ অভিযানের প্রসঙ্গও আসে মোদীর বক্তৃতায়। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ভারতের পতাকা উড়েছে। এটা ভারতের জন্য অত্যন্ত গৌরবের।” এই প্রসঙ্গেই মোদীর সংযোজন, “বাদল অধিবেশন দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই অধিবেশন রাষ্ট্র গৌরব ও বিজয়োৎসবের।”
তাঁর সরকারের আমলে মাওবাদ মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে কী কী উন্নতি হয়েছে, তারও খতিয়ান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “মাওবাদ-নকশালবাদ দেশ থেকে দ্রুত নির্মূল হচ্ছে। বর্তমান ভারতে মাওবাদীদের প্রভাব ক্রমশ কমছে। বোমা-বন্দুক-পিস্তলের সামনে জিতছে দেশের সংবিধান।” ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত ১০ নম্বর স্থান থেকে ৩ নম্বর স্থান অর্জনের দিকে এগোচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “২৫ কোটি ভারতীয় দারিদ্রসীমা অতিক্রম করেছেন। মুদ্রাস্ফীতি আগে ছিল দুই সংখ্যার। এখন দুই শতাংশের আশপাশে।”
আলোচনা হবে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে
শেষ পর্যন্ত প্রবল দাবির মুখে সংসদে ওই ইস্যু নিয়ে আলোচনায় রাজি হয়েছে মোদী সরকার। তবে আলোচনায় রাজি হলেও বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। বিজনেস অ্যাডভাইসরি কমিটি জানিয়েছে, 'অপারেশন সিঁদুর' এবং সংঘর্ষ বিরতি নিয়ে আলোচনা হবে আগামী সপ্তাহে। লোকসভায় পহেলগাঁও এবং অপারেশন সিঁদুর বিষয়ে আলোচনার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১৬ ঘণ্টা। রাজ্যসভায় আলোচনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৯ ঘণ্টা। অপারেশন সিঁদুর বা পহেলগাঁও হামলা নিয়ে সংসদে বিশেষ কোনও অধিবেশন হচ্ছে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল দিয়েছিল কেন্দ্র। এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করেছিল মোদী সরকার।
প্রসঙ্গত, গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর তার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে একাধিক পদক্ষেপ করেছিল ভারত। প্রত্যাঘাতের অভিযান ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ গত ৬ মে মধ্যরাতে পাকিস্তানে হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় একাধিক জঙ্গিঘাঁটি। এর পর পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালায়। দুই দেশের মধ্যে টানা চার দিন সংঘর্ষ চলে। গত ১০ মে ভারত এবং পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয়। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন (ডিজিএমও) স্তরে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে এই সংঘর্ষবিরতি হয়। কিন্তু, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের সংঘর্ষবিরতির কথা প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ট্রাম্প। এর পর একাধিক বার তিনি দাবি করেছেন, তাঁর মধ্যস্থতাতেই দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের সংঘর্ষবিরতি হয়েছে। তবে ইসলামাবাদ ‘ট্রাম্পের’ কৃতিত্ব মেনে নিলেও নয়াদিল্লি তাঁর ওই দাবি স্বীকার করেনি। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রকাশ্য বিবৃতির দাবি তুলেছে বিরোধীরা। বাদল অধিবেশন শুরু আগে রবিবার প্রথমাফিক সর্বদল বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকের পরে রিজিজু বলেন, ‘‘সংসদে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী আমরা। সংসদ যাতে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালিত হয়, তার জন্য শাসক-বিরোধী সমন্বয় থাকা বাঞ্ছনীয়।’’
কেন বিচারপতির বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের উদ্যোগ?
সোমবার থেকে শুরু হয়েছে বাদল অধিবেশন। জানা গিয়েছে, সেখানে ১৪৫ জন সাংসদ লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে বিচারপতির অপসারণ সংক্রান্ত স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া, রাজ্যসভার ৬৩ জন সাংসদও এই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছেন। সূত্রের খবর, কংগ্রেস এবং সিপিএমের মতো বিরোধী দলগুলির পাশাপাশি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি, তেলুগু দেশম পার্টি, জেডি (ইউ) এবং জেডি (এস)-সহ এনডিএ জোটের সাংসদেরাও। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপির প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, কেসি বেণুগোপাল, এনসিপি (শরদ)-এর সুপ্রিয়া সুলে, প্রমুখ। এর পর সংবিধানের ১২৪, ২১৭ এবং ২১৮ অনুচ্ছেদের অধীনে অভিযুক্ত বিচারপতির ইমপিচমেন্টের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা— স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বার!
এর আগে নগদকাণ্ডে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট খতিয়ে দেখে বর্মার ইমপিচমেন্টের বিষয়ে সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিচারপতি বর্মাকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করার আর্জিও জানিয়েছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের হোলির দিন দিল্লি হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বর্মার বাসভবনের গুদামে আগুন লেগে গিয়েছিল। দমকলকর্মীরা আগুন নেবাতে গিয়ে আধপোড়া নোটের রাশি রাশি বান্ডিল উদ্ধার করেন। সেই থেকে বিতর্কের সূত্রপাত। প্রথমে ওই বিচারপতিকে দিল্লি থেকে ইলাহাবাদ হাই কোর্টে সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্রমে মামলার জল গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। শীর্ষ আদালত ওই ঘটনার অনুসন্ধানের জন্য হাই কোর্টের তিন বিচারপতিকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মে মাসে ওই অনুসন্ধান কমিটি একটি মুখবন্ধ খামে রিপোর্ট জমা দেয় সুপ্রিম কোর্টে। তাতে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের দিন বিচারপতি বর্মার বাসভবনের ভিতরে রাশি রাশি টাকার স্তূপ দেখেছিলেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীও। যদিও বিচারপতির দাবি, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না।
কাকে বলে ইমপিচমেন্ট?
ভারতীয় সংবিধানের ১২৪(৪) এবং ২১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের কোনও বিচারপতিকে অপসারণের জন্য সংসদে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা যেতে পারে। এ জন্য প্রাথমিক ভাবে সংসদের উচ্চ কক্ষ তথা রাজ্যসভায় কমপক্ষে ৫০ জন সদস্যের স্বাক্ষর প্রয়োজন। আর লোকসভায় প্রয়োজন ১০০ জনের স্বাক্ষর। যদি প্রস্তাবটি উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পাশ হয়, তা হলে পরবর্তী ধাপ হিসাবে লোকসভার স্পিকার অথবা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান দেশের প্রধান বিচারপতির কাছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের অনুরোধ করবেন। কমিটিতে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের এক জন বর্তমান বিচারপতি, হাই কোর্টের এক প্রধান বিচারপতি এবং সরকারের মনোনীত কোনও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। সেই কমিটির রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পর রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এ বার সেই পথেই হাঁটতে চলেছে সরকার।
মোদীর রাজ্যের বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রের জবাব
সুরক্ষাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে গত ছ’মাসে ন’বার কারণ দর্শানোর (শোকজ়) নোটিস ধরানো হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়াকে! সোমবার সংসদে এমনটাই জানাল কেন্দ্র। এই সময়ের মধ্যে মোট পাঁচ বার উড়ান সংস্থায় সুরক্ষাবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। অহমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়া বিপর্যয়ের পরে গত এক মাসে এই উড়ান সংস্থার একাধিক বিমানে বিপত্তি দেখা গিয়েছে। সোমবারও সকালে মুম্বই বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়েতে পিছলে গিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান। উড়ান সংস্থার পরিষেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রশ্নের মাঝেই এই তথ্য জানাল কেন্দ্র।
অহমদাবাদ বিমান দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে সোমবার রাজ্যসভায় প্রশ্ন করেন সিপিএম সাংসদ জন ব্রিট্টাস। এই সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেন তিনি। বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে এখনও পর্যন্ত কী কী ধরা পড়েছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির সুরক্ষার বিষয়ে গত ছ’মাসে যাত্রীদের তরফে বা ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন’ (ডিজিসিএ)-র তরফে কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল কি না, তা জানতে চান বাম নেতা। বিমানের সুরক্ষা বা ওড়ার ক্ষমতা নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়াকে গত ছ’মাসে কোনও নোটিস পাঠানো হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সাংসদের প্রশ্নের জবাবে অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী মুরলীধর মোহল জানান, গত ছ’মাসে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির বিষয়ে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা দেখা যায়নি। তবে এই ছ’মাসে এয়ার ইন্ডিয়ায় পাঁচ বার সুরক্ষাবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ওই ঘটনাগুলির জন্য উড়ান সংস্থাকে মোট ন’টি শোকজ় নোটিস পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনায় আইনানুগ পদক্ষেপও করা হয়েছে। তবে তদন্তে দুর্ঘটনার কোনও নির্দিষ্ট কারণ এখনও উঠে আসেনি বলেই জানান মোহল। বিমান পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী জানান, তদন্তকারী সংস্থা এয়ারক্র্যাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি) গত ১২ জুলাই একটি প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তদন্তকারী সংস্থার ওয়েবসাইটেও সেটি রয়েছে। দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ খতিয়ে দেখছে এএআইবি।