Advertisement
E-Paper

দেশে এই প্রথম এক সামরিক অভিযান অন্য উচ্চতা পেল নামকরণের জোরে!

অনেকে একে ‘ব্র্যান্ডিং’ বলবেন। অনেকে বলবেন ‘বিপণন কৌশল’। কিন্তু আমার চোখে এ হল জনসংযোগ তথা আদান-প্রদানের এক শক্তিশালী পন্থা। এমন এক জনসংযোগ তথা আদান-প্রদান, যা জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে।

সুহেল শেঠ

সুহেল শেঠ

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৫ ১০:২৭
ভারতীয় সেনার টুইটে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর লোগো।

ভারতীয় সেনার টুইটে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর লোগো। ছবি: এক্স (সাবেক টুইটার)।

‘অপারেশন সিঁদুর’ এখন চর্চার কেন্দ্রে। সে চর্চার নানা কারণ রয়েছে। তবে ‘ব্র্যান্ডিং দুনিয়া’র প্রতিনিধি হিসেবে আমার চোখে সর্বাগ্রে ধরা দিচ্ছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর নেওয়া ‘ব্র্যান্ডিং কৌশল’। ভারতের এই সামরিক অভিযানের নামটি যে ভঙ্গিতে উন্মোচিত হয়েছে এবং তার পরে যে কৌশলে দ্রুত গোটা দেশের সঙ্গে সে নামের পরিচয় ঘটানো হয়েছে, তা আলোচিত হওয়ার মতোই। বিপণন বা ব্র্যান্ডিংয়ের দৃষ্টি নিয়ে যদি কেউ ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর দিকে তাকান, তা হলে বলতেই হবে যে, ভারতীয় বাহিনী ব্র্যান্ডিংয়ের জোরে এই অভিযানকে একটা ভিন্ন মাত্রায় তুলে নিয়ে গিয়েছে।

আনন্দবাজার ডট কম-এর অনুরোধে এই বিশেষ নিবন্ধে সেটাই লেখার চেষ্টা করছি।

এই ধরনের অভিযানের নেপথ্যে তিন রকম উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথম উদ্দেশ্য অবশ্যই অভিযান নিজেই। অর্থাৎ, অভিযান জরুরি ছিল। তাই অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। কারণ, এটা আমার ব্র্যান্ডিং বা বিপণনের জগৎ নয়। এটা হল বীরত্ব ও সামরিক কৌশলের দুনিয়া। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু লিখব না। এই অভিযানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অবশ্যই জনতার মতামত তথা আবেগকে গুরুত্ব দেওয়া। আর তৃতীয় উদ্দেশ্য, দেশের ভিতরে এবং বাইরে সকলকে সোচ্চারে এই সফল অভিযানের কথা জানিয়ে দেওয়া।

এই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য সত্যিই উল্লেখযোগ্য। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও সামরিক অভিযানের নামের প্রচার গোটা অভিযানকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিল।

অনেকে একে ‘ব্র্যান্ডিং’ বলবেন। অনেকে বলবেন ‘বিপণন কৌশল’। কিন্তু আমার চোখে এ হল জনসংযোগ তথা আদান-প্রদানের এক শক্তিশালী পন্থা। এমন এক জনসংযোগ তথা আদান-প্রদান, যা জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে। এমন এক জনসংযোগ তথা আদান-প্রদান, যা অনেক মানুষকে একটা অভিন্ন বোঝাপড়ার পথে নিয়ে যায়। সর্বোপরি, এমন এক জনসংযোগ তথা আদান-প্রদান, যা সামরিক অভিযান বা সেই সংক্রান্ত তথ্যের উপর সাধারণ নাগরিকের বিশ্বাস তৈরি করে।

ব্র্যান্ডিংয়ের কার্যকারিতা সম্পর্কে আমি যে কথাটা সব সময় বলি, ‘অপারেশন সিঁদুর’ সেই কথাটার সারবত্তাকেই আবার প্রমাণিত করেছে। বিষয় যা-ই হোক না কেন, আপনি যদি সেই বিষয়টার কিছুটা ব্র্যান্ডিং করেন, বিষয়টাকে যদি অনেক মানুষের কোনও এক অভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখাতে পারেন, অনেক মানুষকে যদি কোনও উপায়ে বিষয়টার সঙ্গে জুড়ে নিতে পারেন, তা হলে সেই প্রচেষ্টা বহু গুণ বেশি ফলদায়ী হয়। ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঠিক সেই পথেই এগিয়েছে এবং নিমেষে কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নিয়েছে।

‘অপারেশন সিঁদুর’-এর যে ‘লোগো’ তৈরি করা হয়েছে (এবং সারা দেশে দ্রুত যেটা ছড়িয়ে পড়েছে), সেটাই প্রথম বাজিমাত করে দিয়েছে। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে লোগো সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, লোগো সব সময়ই একটা অভিন্ন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের সঙ্গে অনেককে জুড়ে নিতে পারে। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর লোগোটা তৈরিই করা হয়েছে খুব অর্থবহ ভাবে। অসামান্য মুনশিয়ানায় সেটাকে প্রচারের আলোতেও আনা হয়েছে। ‘সিঁদুর’ শব্দটাই তো খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছে! কারণ, সিঁদুর এখানে অনেকগুলো তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিয়েছে। প্রথমত, পহেলগাঁওয়ে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, সিঁদুর সেই ঘটনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে। কারণ, জঙ্গিরা বেছে বেছে পুরুষদের খুন করে মহিলাদের সিঁদুর মুছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় মহিলারা যে গর্বের সঙ্গে সিঁদুর পরেন, সেই গর্ব এই সামরিক অভিযানের নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। তৃতীয়ত, টকটকে লাল গোলাকার একটা সিঁদুরকৌটোকে যে ভাবে ‘সিঁদুর’ শব্দের ইংরেজি বানানে ইংরেজি ‘ও’ বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা একটা দারুণ দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে, যা খুব সহজে আমাদের বোধকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

সেই দৃশ্যকল্পকে আরও শক্তিশালী করেছে দুই মহিলা সেনা আধিকারিকের সাংবাদিক সম্মেলন। ‘অপারেশন সিঁদুর’ সম্পর্কে বিশদ তথ্য ভারতবাসীকে জানানো হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর দুই মহিলা আধিকারিকের মাধ্যমে। অভিযানের নামকরণ যেন সেখানে আরও বেশি সার্থকতা পেয়ে গিয়েছে।

সুতরাং, ব্র্যান্ডিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ সব দিক দিয়ে সফল। যুগটা সমাজমাধ্যমে অতি সক্রিয়তার। সেই অতি সক্রিয়তার সামনে কোনও সীমান্ত কাজ করে না। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বসে যে কোনও বার্তা যে কোনও দেশে প্রায় বিনা বাধায় ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সত্য-মিথ্যা ছেঁকে নেওয়ার কোনও সুযোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকে না। সমাজমাধ্যমে নিরন্তর চলতে থাকা সেই ‘ধারণা-যুদ্ধে’ জিততে হলে ভারতের সামরিক অভিযানের একটা ভাল ব্র্যান্ডিং জরুরি ছিল। এমন ব্র্যান্ডিং জরুরি ছিল, যা মানুষের মন ছোঁবে এবং জনতার স্মৃতিতে স্থায়ী জায়গা করে নেবে। আরও একবার জঙ্গিদের উপরে আমরা আঘাত হেনেছি— শুধু এইটুকু বললে এই অভিযানকেও আর পাঁচটা জঙ্গি দমন অভিযানের থেকে খুব একটা আলাদা বলে মনে হত না। ‘সিঁদুর’ শব্দটা এবং অপারেশন সিঁদুরের লোগো এই অভিযানকে আলাদা করে চিনিয়ে দিল।

পরিচয়ে বিশিষ্টতা যোগ করতে বা সকলের মধ্যে আলাদা করে নজর কাড়তে ব্র্যান্ডিংয়ের আশ্রয় নেওয়া হয়। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামটা এই সামরিক অভিযানের পরিচয়ে বিশিষ্টতাই যোগ করল। সেই নামকে দ্রুত প্রচারে আনার নানা কৌশল ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে ধারণা-যুদ্ধেও এগিয়ে দিল। আমাদের সেনাবাহিনী আসলে শব্দচয়নটা দারুণ ভাবে করেছে। আর একটা অনবদ্য লোগোর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর বক্তব্যের দৃশ্যমান উপস্থাপনাটাও অসামান্য হয়েছে।

‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ব্র্যান্ডিং যে ভাবে হয়েছে, তা আমাদের মনে যে রকম ছাপ ফেলে যায়, সেটা তাৎক্ষণিক নয়। দীর্ঘকাল এ নাম আমাদের সকলের মনে থেকে যাবে। আমাদের মস্তিষ্কে স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে। পাকিস্তানের গভীরে আঘাত হেনে জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারত। এ কোনও ছোটখাটো সাফল্য নয়। ফলে এমনিতেই গোটা দেশে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর নামে জয়ধ্বনি চলছে। কিন্তু এই সফল অভিযানের স্মৃতি যখন ফিকে হবে, এই অভিযানের নামটা তখনও গাঢ় রং নিয়ে আমাদের স্মৃতিতে জেগে থাকবে।

আগে সামরিক অভিযানগুলো কোনও ভৌগোলিক নাম দিয়ে চিহ্নিত হত। আড়াই দশক আগের কার্গিল যুদ্ধ হোক বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জমানার নর্ম্যান্ডি যুদ্ধ। সব যুদ্ধই যুদ্ধক্ষেত্রের নামে পরিচিত হত। ২০২৫ সালের মে মাসে পাকিস্তানের নানা জঙ্গি ঠিকানায় ভারত যে অভূতপূর্ব আঘাত হানল, তাকে ওই রকম কোনও ভৌগোলিক নামে পরিচিত হয়ে থাকতে হবে না। সে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামেই চিরপরিচিত হয়ে গেল।

(লেখক খ্যাতনামী ব্র্যান্ড-গুরু এবং ‘কাউন্সিলেজ ইন্ডিয়া’র ম্যানেজিং পার্টনার। মতামত নিজস্ব)

Pahalgam Terror Attack Jammu and Kashmir Indian Army Operation Sindoor Pak Sponsored terrorism Pakistan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy