একই ধরনের জিনিস। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কর। যেমন, বেশি দামের জিনিসে বেশি কর। আবার কম কর কম দামের জিনিসে। এতকাল এটাই ছিল জিএসটি কাঠামোর উপজীব্য বিষয়। অনেকে বলেন, ভোট-রাজনীতি নজরে রেখে এই কর কাঠামো চলছিল। কিন্তু তাতে প্রত্যাশামতো ঘুরে দাঁড়ায়নি দেশের অর্থনীতি! তা নজরে রেখেই এ বার আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল কেন্দ্রীয় সরকার। নয়া জিএসটি কাঠামো দেখে তাই অনেকেই বলছেন, আদতে নিজের ভুলই শোধরালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
মধ্যবিত্তের সুরাহা করে বাজারে বিক্রিবাটা বাড়ানোই জিএসটি কাঠামোর লক্ষ্য থাকে। কিন্তু অর্থনৈতিক মহলের দীর্ঘ দিনের বক্তব্য, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০২২ সালে যে কর-কাঠামো ঘোষণা হয়েছিল, তাতে ক্রেতাদের খুব একটা সুরাহা হয়নি। তাই প্রত্যাশামতো চাঙ্গা হয়নি বাজার। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর চাহিদাও তৈরি হয়নি ক্রেতাদের মধ্যে। এ সব মাথায় রেখেই পণ্য ও পরিষেবা কর-কাঠামোয় আমূল বদল আনা হল বলে মনে করছেন অনেকে।
পাশাপাশি সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির উপরেও কিছু চাপ ছিল। অতিমারির পর থেকেই অর্থনীতির চাকার গতি কমেছে। সেই সঙ্গে চড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং গৃহস্থের হাতে টাকার অভাব বহু দিন ধরেই প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বিক্রি শ্লথ করেছে। তার উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ! ভবিষ্যতে তারও প্রভাব পড়ার কথা অর্থনীতিতে। যদিও কেন্দ্রের দাবি, নয়া কর-কাঠামো নিয়ে গত বছর দেড়েক ধরে কাজ চলছিল।
জিএসটি কাঠামোয় যে বড়সড় বদল আসতে পারে, তেমন গুঞ্জনও ছিল বাজারে। সেই কারণে সম্প্রতি বিক্রিবাটা আরও পড়ে গিয়েছিল বলে জানাচ্ছেন অনেকে। বাজারের হালচাল যাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁদেরই একাংশের মত, দাম কমার আশায় গাড়ি-ওয়াশিং মেশিনের বিক্রি কমেছিল। অনীহা তৈরি হয়েছিল বিমার পুনর্নবীকরণেও।
বাস্তবেও তা-ই হল। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, বাইক-গাড়ি, বিমা— সব ক্ষেত্রেই সুরাহা দিল সরকার। নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হবে ২২ সেপ্টেম্বর থেকে। মনে করা হচ্ছে, জিএসটির হার কমানোর ফলে জিনিসপত্র কেনাবেচা বাড়বে এবং এই পন্থা অর্থনীতির দাওয়াই (স্টিমুলাস) হিসেবে কাজ করবে। ফলে চাঙ্গা হবে অর্থনীতি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তাঁর এক্স হ্যান্ডলে বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাতেই তিনি জিএসটির হারে সংস্কার করার কথা বলেছিলেন। কেন্দ্র জনগণকে সুরাহা দেওয়ার লক্ষ্যে সেই কাজটিই করেছে।
যদিও বিরোধীদের দাবি, এত দিন বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি সত্ত্বেও অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে চড়া হারে জিএসটি চাপিয়ে মানুষের উপরে করের বোঝা বাড়িয়েছিল কেন্দ্র। এখন অর্থনীতি নিয়ে চাপের মুখে বিহার ভোটের আগে সেটাই কমিয়ে বাহবা নিতে চায় তারা।
তবে বিশেষজ্ঞদের মত, নয়া জিএসটি কাঠামোয় ক্রেতাদের মধ্যে আচরণগত বদল দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে। শুধু মধ্যবিত্ত ক্রেতাই নন, লাভবান হবেন উচ্চবিত্তেরাও। প্যাকেটজাত নিত্যপণ্য যেমন ঘি, মাখন, মাংস, কফি, মুখরোচক খাবার ইত্যাদি জিনিসের কর কমে ৫ শতাংশ হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই দাম কমবে। ফলে তাতে বাজারে এ সব জিনিসের চাহিদা বাড়বে। ফলে বিক্রিও বাড়বে। ঘরে তৈরি চিজ়-পনিরেও কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, যাতে বিক্রি বাড়ে। এই ধরনের ছোটশিল্পকে উৎসাহ দেওয়াও লক্ষ্য ছিল সরকারের।
মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য এসি-র মতো দামি বৈদ্যুতিন পণ্যে জিএসটি-হার ২৮ থেকে ১৮ শতাংশে নেমে আসবে। ছোট গাড়ি, ৩৫০ সিসি-র কম ইঞ্জিনের বাইকে জিএসটি ২৮ থেকে ১৮ শতাংশে নেমে আসছে। অনেকের মত, এতে ছোট গাড়ির বিক্রি বাড়তে পারে। ১২০০ সিসি-১৫০০ সিসি ইঞ্জিনের এবং ৪ মিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যের বড় গাড়িগুলির দামও কমতে পারে ২-৫ শতাংশ। এত দিন সেগুলিতে জিএসটি এবং সেস মিলিয়ে ক্রেতাকে দিতে হত ৪৭-৫২ শতাংশ। এ বার তাতেও দাম কমার ফলে উচ্চবিত্তেরও সুরাহা হবে বলেই মনে করছেন অনেকে।
ব্যক্তিগত জীবন বিমা ও স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামে জিএসটি-র হার শূন্যে নেমে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই দাবি তুলেছিলেন।
কেন্দ্র মনে করছে, অদূর ভবিষ্যতে করের বোঝা কমার ফলে কেনাকাটা বাড়বে। তার ফলে জিএসটি থেকে আয় বাড়বে। জিএসটি-র হার কমলে, কর আদায় নিয়ে বিবাদ কমবে। তার ফলেও রাজস্ব আয় বাড়বে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দাবি, সামগ্রিক ভাবে ব্যবসার পরিবেশ সহজ হবে। আর এই করের আওতায় গরিব, মধ্যবিত্ত সকলেই পড়ে। তাই করের হার কমলে সকলেই সুবিধা পাবে। এই ছাড় সে দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।