Advertisement
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
National News

হরিশ সালভে এখন জাতীয় হিরো

এক টাকায় এখনকার দিনে কী কী পাওয়া যায়? প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো একটা পোস্টে। উত্তরও রয়েছে সেই পোস্টেই। অমুক ক্যান্ডি পাওয়া যায়, তমুক শ্যাম্পুর স্যাশে মেলে, এক বাক্স দেশলাই হয়। আর পাওয়া যায় ‘পাকিস্তানের পরাজয়’।

ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৭ ১৭:০৫
Share: Save:

এক টাকায় এখনকার দিনে কী কী পাওয়া যায়?

প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে বেড়ানো একটা পোস্টে। উত্তরও রয়েছে সেই পোস্টেই। অমুক ক্যান্ডি পাওয়া যায়, তমুক শ্যাম্পুর স্যাশে মেলে, এক বাক্স দেশলাই হয়। আর পাওয়া যায় ‘পাকিস্তানের পরাজয়’।

শেষ লাইনটা পড়ার পর আর বুঝতে বাকি থাকে না, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব পোস্টের বিষয়বস্তু আসলে হরিশ সালভের নেওয়া ফি। আন্তর্জাতিক আদালতে অসামান্য লড়াই দিয়ে কুলভূষণ যাদবের মৃত্যুদণ্ডের উপর স্থগিতাদেশ আদায় করে এনেছেন আইনজীবী হরিশ সালভে। দেশের সবচেয়ে নামী ১০ জন আইজীবীর তালিকা তৈরি হলে, সালভের নাম সে তালিকায় একেবারে উপরের দিকে থাকে। কোনও মামলা লড়তে সর্বোচ্চ ফি নিয়ে থাকেন যাঁরা, সালভে তাঁদেরই এক জন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে দেশের হয়ে লড়তে তিনি নিয়েছেন এক টাকা। বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এই তথ্য প্রকাশ্যে আনার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে সালভেকে নিয়ে। সংবাদমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে চর্চার শেষ তো নেই-ই। সামাজিক মাধ্যমও প্রবল উৎসাহিত— কোনও পোস্টে সালভের জয়ধ্বনি, কোনও পোস্টে তাঁর দেশপ্রেমকে কুর্নিশ, কোনও পোস্টে সালভেকে ‘বাহুবলী’ সাজানো, কোথাও আবার পাকিস্তানকে নিখাদ কটাক্ষ।

যে কোনও মামলার শুনানিতে এক বার অংশ নিতে যিনি ৬ লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে থাকেন, সেই হরিশ সালভে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে আন্তর্জাতিক আদালতে দেশের হয়ে লড়লেন— এই বিষয়টি উল্লেখয়োগ্য ঠিকই। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সালভের অসাধারণ সওয়াল। যে ভাবে সালভে ভারতের বক্তব্যটা তুলে ধরলেন আন্তর্জাতিক আদালতে, যে ভাবে সাজালেন মামলা, তাতেই নাস্তানাবুদ হতে হল পাকিস্তানকে:

হরিশ সালভের এই অকাট্য সওয়ালের কোনও নির্দিষ্ট জবাব ছিল না পাকিস্তানের কাছে। পাক প্রতিনিধিরা তাই বার বার আন্তর্জাতিক আদালতের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। কিন্তু সে কৌশল শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকল না।

যাঁকে নিয়ে এত চর্চা এখন দেশে, তাঁর সাফল্যের খতিয়ানটা কিন্তু অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা এন কে পি সালভের ছেলে হরিশ সালভে প্রথমে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। আইন পাশ করার পর ১৯৮০ সালে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ভারতের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল তথা স্বনামধন্য আইনজীবী সোলি সোরাবজির সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত দেশের সলিসিটার জেনারেল পদেও ছিলেন। পরবর্তী তিন বছরের জন্যও তাঁকে ওই পদে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু সালভে আর সে পদ নেননি।

আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের হয়ে আগেও সফল হয়েছেন হরিশ সালভে। ভারত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মানছে না বলে অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল মার্শাল আইল্যান্ডস। ভারতের তরফ থেকে যে প্রতিনিধিরা সে সময় আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির হয়ে মার্শাল আইল্যান্ডসের অভিযোগ নস্যাৎ করেছিলেন, হরিশ সালভে তাঁদের অন্যতম।

ভারতীয় শিল্পপতিদের মধ্যে যাঁরা শীর্ষ স্থানে, সেই অম্বানিরা হরিশ সালভের ক্লায়েন্ট। মিত্তলরাও একই পথের পথিক। ভোডাফোনের মতো বহুজাতিক সংস্থাও ভারতে যে কোনও আইনি জটিলতা কাটাতে হরিশ সালভের দ্বারস্থ হয়। ভোডাফোন যখন হাচ নেটওয়ার্ককে (হাচিনসন) অধিগ্রহণ করেছিল, সে সময় কর সংক্রান্ত বিষয়ে ভোডাফোনের সঙ্গে মতবিরোধ তৈরি হয় ভারত সরকারের। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। সে মামলায় সুপ্রিম কোর্টে ভোডাফোনের কৌঁসুলি ছিলেন এই সালভেই। রায় কিন্তু কেন্দ্রের পক্ষে যায়নি।

এমন বেশ কিছু ক্লায়েন্টের হয়ে সালভে মামলা লড়েছেন, সাধারণ জনমত যাঁদের পক্ষে ছিল না, মামলায় জয়ের সম্ভাবনাও ছিল খুব কম। কিন্তু অভিযুক্তদের বক্তব্যে সালভের বিশ্বাস ছিল এবং মামলাও চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছিল। তাই নির্দ্বিধায় লড়াই শুরু করেছিলেন। তেমনই এক মামলা হল আরুষি-হেমরাজ হত্যা মামলা। আরুষির মা-বাবা নুপূর ও রাজেশ তলবারের হয়ে সওয়াল করেছিলেন সালভে। দক্ষিণ দিল্লির উপহার সিনেমা অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিগ্রস্তদের হয়েও এই হরিশ সালভেই লড়েছিলেন। সালভের ঘনিষ্ঠরা বলছেন, এই প্রথম তিনি নামমাত্র পারিশ্রমিকে লড়ছেন, তা নয়। আগেও অনেক মামলা তিনি নিখরচায় লড়েছেন।

আরও পড়ুন: কুলভূষণ মামলায় ধাক্কা, পাক মিডিয়ায় নওয়াজরা তীব্র সমালোচনার মুখে

শুধু দেশে নয়, আইনজীবী হিসেবে বিদেশেও সালভের কদর একই রকম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের মীমাংসা করতে সালভের ডাক পড়ে নানা দেশ থেকে।

কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরোধে হরিশ সালভে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা লড়ছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি যে চির কালই বর্তমান শাসক দলের খুব কাছের ছিলেন, তা একেবারেই নয়। গুজরাত দাঙ্গা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট হরিশ সালভেকে গুজরাত হাইকোর্টের পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেছিল। সে মামলায় গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে যে বার বার অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল, সে কথা কারও অজানা নয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অনুরোধে গুজরাত দাঙ্গার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত বিলকিস বানোর হয়েও হরিশ সালভেই আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: ভারতের এই জয় অসামান্য, স্বীকার করতেই হবে

ভারতের বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগির সঙ্গেও সম্প্রতি একাধিক বার সালভের মতবিরোধ হয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপের গোপনীয়তা সংক্রান্ত একটি মামলা সম্প্রতি বিচারাধীন। দুই আইন-পড়ুয়াই মামলাটি দায়ের করেছেন। সালভে মামলাকারীদের হয়ে লড়ছেন। আাদলতে তাঁর সওয়াল— হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের সব আদান-প্রদান হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষকে গোপন রাখতে হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল তথা সরকার এই গোপনীয়তার নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকারি অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে সালভের সওয়াল— এই গোপনীয়তা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শুধুমাত্র সালভে শুনানিতে অংশ নিতে পারছেন না বলে, মামলাটির শুনানি পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জুলাইয়ে মামলাটির শুনানি হবে।

সম্প্রতি আরও একটি বিষয় নিয়ে লড়াই হয়েছে সালভে এবং রোহতগির। উত্তরপ্রদেশের সপা নেতা আজম খান বুলন্দশহর ধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতেই সালভে এবং রোহতগি পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। অ্যাটর্নি জেনারেল রোহতগির বক্তব্য, রাজনীতিকদেরও বাকস্বাধীনতা থাকা উচিত, তাঁদের মন্তব্য অন্যদের উপর কী ভাবে প্রভাব ফেলবে, সব সময় তা ভেবে রাজনীতিকরা কথা বলবেন, এমনটা হতে পারে না, মত রোহতগির। কিন্তু সালভে অ্যাটর্নি জেনারেলের এই অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন এবং প্রশ্ন করেছেন— সরকার কেন দেশকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে?

এমন সোজা-সাপ্টা হরিশ সালভেই যে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হতে পারেন, তা বুঝতে বিদেশ মন্ত্রকের অসুবিধা হয়নি। আর কুলভূষণ মামলায় দেশের হয়ে লড়ার প্রস্তাব পেয়ে হরিশ সালভেও দু’বার ভাবেননি।

অন্য বিষয়গুলি:

Harish Salve International Court Of Justice Kulbhushan Jadhav India-Pakistan National Hero ভারত পাকিস্তান
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy