Advertisement
E-Paper

করাচিতে কোপ, ইতিহাসই কিন্তু আহত হচ্ছে

উপমহাদেশে দোকান-বাজারের নামকরণে স্থানমাহাত্ম্য জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা অনেক দিনের। কখনও তা আত্মপরিচয়ের তাগিদে, কখনও খদ্দের ধরার কৌশলে, কখনও বা গুণমানের বিজ্ঞাপন হিসেবে। যেমন উত্তর ভারত থেকে গিয়ে কেউ যদি শিলংয়ে কারবার ফাঁদেন, দোকানের নাম দেন ‘দিল্লি সুইটস’!

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:২৭
পাকিস্তানে ভারতীয় নামযুক্ত দোকান, যেগুলির ছবি উঠে এসেছে টুইটারে।

পাকিস্তানে ভারতীয় নামযুক্ত দোকান, যেগুলির ছবি উঠে এসেছে টুইটারে।

পুলওয়ামার ‘জবাবে’ পাকিস্তান আর কাশ্মীরকে বয়কট করার ডাক এসেছে দেশভক্তদের তরফে। পাকিস্তানের সঙ্গে শিল্প-সংস্কৃতির আদানপ্রদান বন্ধ। ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে সরে গিয়েছে পাক ক্রিকেটারদের ছবি। ছাড় পায়নি বেঙ্গালুরুর প্রাচীন দোকান করাচি বেকারিও।

সন্ত্রাসের প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিন্তু আদতে ইতিহাসই আক্রান্ত হচ্ছে, মনে করাচ্ছেন ইতিহাসবদিরা। নাম বদলে দেওয়া, মুছে দেওয়ার এই প্রবণতার মধ্যে ইতিহাসকে মুছে দিতে চাওয়া হচ্ছে বলেই তাঁদের মত। এমনকি স্বাধীনতার পরে শহরের অভিজ্ঞান, পথনাম থেকে সাহেবি অনুষঙ্গ ছেঁটে ফেলাটাও যুক্তিযুক্ত ছিল কি না, প্রশ্ন আছে তা নিয়ে। তবু সে এক বৃহত্তর বিতর্কের বিষয়। কিন্তু করাচি বেকারিতে হামলার মতো ঘটনা স্রেফ বিদ্বেষপুষ্ট এবং সর্বতো ভাবে নিন্দনীয় বলেই মনে করছেন তাঁরা।

উপমহাদেশে দোকান-বাজারের নামকরণে স্থানমাহাত্ম্য জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা অনেক দিনের। কখনও তা আত্মপরিচয়ের তাগিদে, কখনও খদ্দের ধরার কৌশলে, কখনও বা গুণমানের বিজ্ঞাপন হিসেবে। যেমন উত্তর ভারত থেকে গিয়ে কেউ যদি শিলংয়ে কারবার ফাঁদেন, দোকানের নাম দেন ‘দিল্লি সুইটস’! ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির চোখ টানতে হিমালয়ের কোলে ঝাঁপ তোলে ‘বাঙালি হোটেল’। চুল ছাঁটতে হংকং সেলুনের দেখা মেলে অহরহ। সাম্প্রতিক বয়কট জিগিরের আবহে কাশ্মীরি চপ বা কাশ্মীরি আলুর দম মুখে তোলা উচিত কি না, তাই নিয়ে রসিকতার মোড়কে প্রতিবাদ করছিলেন অনেকে। দিকে দিকে কাশ্মীরি শালওয়ালদের উপরে আক্রমণ এবং করাচি বেকারিতে হামলার পরে রসিকতা মিলিয়ে গিয়ে আশঙ্কার মেঘই ঘন হচ্ছে ক্রমশ।

করাচি বেকারি-র কর্তারা দেশভাগের সময়ে করাচি থেকে হায়দরাবাদে এসে ঘাঁটি গাড়েন। ফেলে আসা দেশের একটা টুকরোই তাঁরা ধরে রেখেছিলেন দোকানের নামের মধ্যে। তারই একটি শাখা আক্রান্ত হয়েছে বেঙ্গালুরুতে। ‘‘করাচি নামের জন্য আক্রমণ করা মানে ওই বেকারির সঙ্গে জড়িত উপমহাদেশের ইতিহাসের অনুষঙ্গটাই মুছে ফেলতে চাওয়া,’’ বলছেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর-সচিব, ইতিহাসবিদ জয়ন্ত সেনগুপ্ত।

কলকাতার পার্ক স্ট্রিট পাড়ার সাবেক রেস্তোরাঁমালিকদেরও চোদ্দো আনাই দেশভাগের পরে করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি থেকে কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন। জয়ন্তবাবুর মতে, সাম্প্রতিক রাজনীতি যা-ই বলুক, উপমহাদেশ জুড়ে কয়েক শতাব্দীর সাংস্কৃতিক মেলামেশা আর আদানপ্রদানের ইতিহাস!

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে মুলতানি মাটি, করাচি হালুয়া, এমনকি ঢাকাই পরোটা-বাখরখানিও সেই ইতিহাসের স্মারক। জয়ন্তর কথায়, ‘‘নামগুলো কেটেছেঁটে এই ইতিহাস ভুললে নিজেদের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হবে!’’ ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস ‘দেশভক্ত’দের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘ইতিহাসগত ভাবে গোটা উপমহাদেশই যে অভিন্ন সাংস্কৃতিক ভূখণ্ড ছিল, এই সব নাম তারই প্রতীক। আক্রমণ নয়, আমাদের আশু কর্তব্য এগুলো আগলে রক্ষা করা।’’

ইতিহাসের প্রবহমানতা মেনেই কলকাতায় এসে কাঠবাঙালের শাড়ির দোকান ‘ঢাকেশ্বরী’ কিংবা বোহরা মুসলিমদের মিষ্টির দোকানের নাম ‘বম্বে সুইটস’ হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। এমনই কত ‘নিউদিল্লি’ বা ‘বেঙ্গল’ কি ‘ক্যালকাটা স্টোর্স’ ছড়িয়ে আছে দেশে, দেশের বাইরেও। খোদ শ্রীনগরেই রয়েছে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি তালুকের পরশধন্য ‘বেঙ্গালুরু কম্পিউটার্স’ নামে একটি বিপণি। সরাইবালা এলাকায় বাঙালি মালিকের দোকান, ‘ক্যালকাটা অর্নামেন্টস’! ৩৮ বছরের পুরনো! প্রসিদ্ধ লাল চক এলাকায় জ্বলজ্বল করছে ‘ক্যালকাটা কাঠি রোল’।

‘‘আসলে নামের সঙ্গে স্থানমহিমার যোগসূত্র খোঁজাটা বিপণনেরও কৌশল,’’ বলছেন বিজ্ঞাপন নির্মাতা সৌভিক মিশ্র। তা-ই তো ‘হলিউড টেলার্স’ বা ‘প্যারিস বিউটি পার্লার’-রা জাঁকিয়ে বসে। মেদিনীপুরি রাঁধুনেদের হাতযশে তৈরি বিরিয়ানি বা তড়কার দোকানও অনায়াসে লখনউ কি অমৃতসর থেকে নাম ধার করে! ঢাকাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে স্থাননামই তার ইউএসপি হয়। ‘‘কিন্তু এখন যা দিনকাল, তাতে ব্র্যান্ড বা কোনও আইটেমের নামে লাহৌর-করাচি রাখতে অনেকেই ভয় পাবেন,’’ বলছেন সৌভিক। জয়ন্তবাবুর শঙ্কা, ‘‘এ বার কি ভিক্টোরিয়ার মার্বেল মুলতানি মাটি দিয়ে পরিষ্কার করা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে?’’

আশার কথা, সৌদি যুবরাজের সম্মানে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ভোজ-মেনুতেও কাশ্মীরি রোগান জোশ বা ভূস্বর্গের কেহওয়া চা ব্রাত্য ছিল না। ফলে সন্দেশের ‘পাক’ কড়া না নরম, সেটা হয়তো আতসকাচের তলায় পড়বে না।

Pulwama Terro attack Protest Bakery Intolerance Patritotism History
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy