রবিবার রাতের অন্ধকারে বারণসী থেকে প্রয়াগরাজে পৌঁছনোর তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লেগেছে অন্তত সাত ঘণ্টা। সোমবার সকালের পর থেকে রোদ যত চড়চড়ে হয়েছে, যাত্রাপথের সময় আরও বেড়েছে। তবু মানুষ ছুটছে ত্রিবেণী সঙ্গমের মহাকুম্ভে।
বারাণসী, লখনউ, কানপুর— যে কোনও শহর থেকে প্রয়াগরাজে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেছে বাস, ছোটগাড়ি। রাস্তাতেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুণ্যার্থীরা নেমে হাঁটতে শুরু করেছেন কুম্ভের দিকে। রাস্তায় শৌচাগারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে মহিলারা দিনের আলোতেই চাষের খেতে, মাঠে শৌচকর্ম সেরেছেন। তবু মানুষ ছুটেছে মহাকুম্ভের রাস্তায়।
রবিবার থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রয়াগরাজ সঙ্গম স্টেশনে যাত্রী চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রেল। তার পরেও মানুষ এসেছে গাড়ি ভাড়া করে, ভ্যান রিকশায় চেপে, হেঁটে। উদ্দেশ্য, যে ভাবেই হোক আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি মাঘী পূর্ণিমার ‘অমৃত লগ্নে’ গঙ্গায় পুণ্যস্নান করা। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির শেষ স্নানের আগে বুধবারের এই স্নান। সেই স্নানে যাওয়া ভিড়ের চাপে প্রয়াগরাজে যাওয়ার তিনশো কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে সোমবার নজিরবিহীন যানজট দেখেছে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য। বিহার, মধ্যপ্রদেশ থেকে উত্তরপ্রদেশে ঢোকার সব পথ রূদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, মাইক হাতে পুলিশকে ঘোষণা করতে দেখা যায়, “স্নান করে কেউ ঘাটে দাঁড়াবেন না। আরও পুণ্যার্থীরা পিছনে আছেন।”
প্রয়াগরাজ, ঝুসির বাসিন্দারা দাবি করছেন, এ বারের মহাস্নানের আগে প্রশাসনের ‘কড়াকড়ি'তে কুম্ভের চেহারাই যেন বদলে গিয়েছে। সোমবার সকাল থেকে গঙ্গার দু’পাশের ঘাট থেকে সঙ্গমে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। ঘাটে স্নান চলাকালীন বার বার সিভিল ডিফেন্স থেকে পুরসভার কর্মীরা পুণ্যার্থীদের এসে তাগাদা দিয়েছেন। সকাল থেকেই প্রয়াগরাজে ছোট-বড় গাড়ি ঢোকা বন্ধ করা হয়েছে। গত মৌনী অমাবস্যায় দুর্ঘটনার পর থেকে প্রশাসন হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল করছে বলে অভিযোগ। মেলায় ভিড় বাড়লেই চারদিক থেকে যানবাহন ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কখন, কোন রাস্তায় যান চলাচল নিষিদ্ধ হবে, কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। তাও ভিড় আটকাতে নাজেহাল প্রশাসন।
রাজৌরি থেকে বাসে কুম্ভে রওনা দিলেও ভোর রাতে প্রয়াগ থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে বাস আটকে রয়েছে। অজয় পাণ্ডে তাঁর স্ত্রী সুরতী দেবী এবং আত্মীয়া বৈচি দেবীকে চাদর দিয়ে বেঁধে কুম্ভে স্নান করতে এগিয়েছেন। অজয় বলেন, “ভিড় থাকবে বলে মাঘী পূর্ণিমার দু’দিন আগেই রওনা দিয়েছিলাম। তবু দশ কিলোমিটার হাঁটতে হল। মেলাতেও ঢুকতে প্রায় দু’ঘণ্টা লাগল।”
রাত নামতেও মানুষের স্রোতের বিরাম নেই। সোমবার সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রয়াগরাজ যাওয়ার রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার বাস, ছোট গাড়ির সারি। রাস্তার ধারে, মাটি পাথরের ফুটপাতে বসে-শুয়ে অপেক্ষা করেছেন লক্ষ লক্ষ মহিলা-পুরুষ, শিশুও। ও দিকে কুম্ভের মাঠে অট্টালিকার মতো তাঁবু পড়েছে। যে দিকে তাকাই, থিকথিকে কালো মাথার ভিড়। তার মধ্যেই আচমকা হুটার বাজিয়ে ছুটেছে ভিআইপি গাড়ি। গাড়ি বোঝাই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয় পরিজনরা। মেলার মধ্য দিয়ে তিরবেগে ছুটেছে সাধুদের বিভিন্ন আখড়ার গাড়িও।
মনে পড়ে গেল, পদপিষ্টের ঘটনার পরে ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। হুস করে ছুটে যাওয়া সেই সব গাড়ির দিকে তাকিয়ে পুণ্যার্থীরা বলছেন, ‘‘তা হলে ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ করা গেল না!’’
প্রয়াগরাজে একাধিক নতুন শিবির তৈরি করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। খোলা মাঠে তাঁবু ফেলে বানানো হয়েছে শিবির। সেখান থেকে চলছে নজরদারি। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এক কর্তা প্রয়াগরাজে ঢোকার আগে চিনিকল মাঠের সামনে ভিড় সামলাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “কোটি কোটি পুণ্যার্থী আসছেন। কত শৌচালয় তৈরি সম্ভব? সেগুলি তৈরি হলেও পরিষ্কার রাখা সম্ভব হত কি?”
প্রথমে অগ্নিকাণ্ড, তার পরে পদপিষ্টের ঘটনা। পরে ফের কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড। একাধিক দমকলের ইঞ্জিন রাখা হয়েছে মেলায়। তবে আখড়াগুলি ফাঁকা হতে শুরু করেছে। শিবরাত্রির জন্য সাধুরা রওনা দিয়েছেন উজ্জয়িনী।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)