বোমার সঙ্গে কোনও তার ছিল না। টাইমার ডিভাইস, মানে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড বেঁধে রাখা ঘড়িও লাগানো ছিল না। তবু মোক্ষম সময়ে অব্যর্থ বিস্ফোরণ উড়িয়ে দিল নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি!
আসলে জঙ্গিরা ওখানে দূর নিয়ন্ত্রিত, বেতার আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস)-র ফাটিয়েছিল। কেব্ল বা টাইমার ডিভাইস না-থাকায় বোমার অস্তিত্ব আগাম টের পাওয়া যায়নি।
ঝাড়খণ্ডের ধারধারিয়া পাহাড়ে চার বছর আগের ওই ঘটনায় ১১ জন নিরাপত্তারক্ষীর প্রাণ যায়। ভারতে দূর নিয়ন্ত্রিত বেতার বোমা দিয়ে বড় নাশকতা ওই প্রথম। এখন প্রধানমন্ত্রী-সহ দেশের ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দূর নিয়ন্ত্রিত বেতার-বোমা থেকেই সবচেয়ে বেশি বিপদের আশঙ্কা করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এ বিষয়ে সম্প্রতি রাজ্যগুলোকে যে বিশেষ সতর্ক-বার্তা পাঠিয়েছে, তাতেই উদ্বেগের মাত্রা পরিষ্কার।
বার্তায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-র যুগ্ম অধিকর্তা মনোজকুমার লাল জানিয়েছেন, অন্য যে কোনও আইইডি-র তুলনায়, এমনকী টাইমার ডিভাইস লাগানো আইইডি’র চেয়েও অনেক বেশি কার্যকরী এই দূর নিয়ন্ত্রিত (রিমোট কন্ট্রোল়্ড), তারবিহীন আইইডি। কারণ, এমনিতেই তা শনাক্ত করা মুশকিল। উপরন্তু শিকার কখন বোমার একেবারে নাগালে এসে পড়ছে, দূর থেকে তা দেখে নিয়ে অনায়াসে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়।
অর্থাৎ, নিরাপদ দূরত্বে বসে মারণ আঘাত হানতে বেতার-বোমার জুড়ি নেই। পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে। আইবি’র হিসেবে, দেশে আইইডি বিস্ফোরণের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে বেতার আইইডি বিস্ফোরণ সাকুল্যে ১০% হলেও তাতে প্রাণহানির সংখ্যা বহু গুণ বেশি।
এইা অবস্থায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। যার প্রেক্ষাপট হিসেবে উঠে আসছে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা। কী রকম?
কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর: জনবহুল জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এক সঙ্গে বহু মানুষের প্রাণহানির কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা সম্প্রতি ভেস্তে গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে এনআইএ-র দাবি: শ্রীলঙ্কায় ঘাঁটি গেড়ে পড়শি একটি দেশের কিছু জঙ্গি চেন্নাইয়ের মার্কিন কনস্যুলেটে হামলার ছক কষেছিল। মতলবটি তারা বানচাল করে দিয়েছে। পাশাপাশি খাগড়াগড়ে দুর্ঘটনামূলক বিস্ফোরণের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে ফুলে-ফেঁপে ওঠা আন্তর্জাতিক জিহাদি-জঙ্গি নেটওয়ার্ক বেআব্রু হয়ে পড়েছে এনআইএ-তদন্তে।
তবু গোয়েন্দারা বিপদেরই গন্ধ পাচ্ছেন। আইবি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘জঙ্গিরা এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, নতুন করে প্রচারের আলোয় আসতে ও জনমানসে আতঙ্ক ছড়াতে তারা বড়সড় কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছে। এ বার তাদের লক্ষ্য হতে পারেন কোনও ভিভিআইপি।’’
এবং এরই সূত্র ধরে সামনে আসছে বেতার-বোমার প্রসঙ্গ। ‘‘জঙ্গিরা চাইছে ভিভিআইপি’র যাত্রাপথে তারহীন, রিমোটচালিত আইইডি দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে, যাতে প্রাণনাশ সুনিশ্চিত করা যায়’’— বলছেন এক আইবি-কর্তা। দেশি-বিদেশি সূত্রে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট খবর মিলেছে বলে তাঁর দাবি। আইবি-অফিসারটি এ-ও বলেন, ‘‘ভিড়ভাট্টায় বোমা ফাটিয়ে বহু সাধারণ মানুষকে মারার বদলে এক জন ভিআইপি-কে খুন করতে পারলে প্রভাব স্বভাবতই বেশি পড়বে। আবার জনাকীর্ণ জায়গায় বিস্ফোরণে কারও প্রাণহানি না-ও ঘটতে পারে, যেমনটি হয়েছিল বুদ্ধগয়ায়।’’
তাই জঙ্গিরা রিমোট কন্ট্রোল়্ড, বেতার আইইডি দিয়ে ভিআইপিদের ‘টার্গেট’ করতে চাইছে বলে আইবি’র ধারণা। উপরন্তু গাড়ির দরজার অ্যালার্ম, তারহীন ডোরবেল, রিমোটচালিত খেলনা, মোবাইল ফোন, ট্র্যানজিস্টর বা দূর পাল্লার কর্ডলেস ফোনের মতো সহজলভ্য জিনিস থেকে জঙ্গিরা হাতের গোড়ায় পেয়ে যাচ্ছে ওই মারণাস্ত্র তৈরির সাজ-সরঞ্জাম।
বিপদ ঠেকানোর উপায় নেই?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি না-হলেও জ্যামার অনেকটা কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। ভিআইপি’র গাড়ির চারধারে তা অদৃশ্য ছাতা তৈরি করে দেয়, যার বাধায় বেতার সঙ্কেত আইইডি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এই কারণেই কনভয়ে ভিআইপি’র গাড়ির ঠিক পরেই জ্যামার মোতায়েন রাখা উচিত।
বস্তুত এক যুগ আগে জ্যামারই বাঁচিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফকে। ২০০৩-এর সেই দিনে রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের যাত্রাপথে মজুত রাখা হয়েছিল আড়াইশো কেজি বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি রিমোটচালিত বেতার বোমা, জ্যামারের দৌলতে যা সময় মতো ফাটতে পারেনি। আবার জ্যামার ব্যর্থ হওয়ার নজিরও আছে। ২০০৩-এই তিরুপতিতে অন্ধ্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডুর কনভয়ে মাওবাদী বিস্ফোরণ কোনও জ্যামার আটকাতে পারেনি। চন্দ্রবাবু যদিও একটুর জন্য বেঁচে যান। কারণ, বোমাটি ফাটাতে জঙ্গিরা কয়েক সেকেন্ড দেরি করে ফেলেছিল।
কিন্তু প্রতি বার জঙ্গিরা দেরি করে ফেলবে, কিংবা জ্যামার বাঁচিয়ে দেবে, এমন গ্যারান্টি কোথায়? তাই গোয়েন্দাদের কপালের ভাঁজও বাড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy