Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সব দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভারত, তাই সুর নরম পাকিস্তানের

পাকিস্তান ধরপাকড় শুরু করেছে। পঠানকোট হামলার চক্রীদের খুঁজে বার করার চেষ্টা হচ্ছে। ইসলামাবাদের তরফে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু সত্যিই কি পাকিস্তান চায়, তাদের মাটি থেকে ভারতে সন্ত্রাস রফতানি করা বন্ধ হোক? না কি চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা? নওয়াজ শরিফ শান্তির পক্ষে হতেই পারেন। কিন্তু তাঁর দেশের সেনা তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে কি? পাকিস্তানের ভিতরে এখন টানাপড়েন তীব্র। আবার পড়শি দেশ ও আমেরিকাকে পাশে নিয়ে ভারত প্রবল বাড়িয়েছে চাপ। পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় সেনার প্রাক্তন পদস্থ কর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায়।প্রবল চাপে পড়েছে পাকিস্তান। পঠানকোট হামলার জেরে পাকিস্তান ঘেরাও হয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলির হাতে। তোপ দাগতে শুরু করেছে আমেরিকাও। জইশ-ই-মহম্মদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে। ওই জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকটি দফতর সিল করে দিয়েছে ইসলামাবাদ।

অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল সৌমিত্র রায়
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ ১৪:৫৬
Share: Save:

প্রবল চাপে পড়েছে পাকিস্তান। পঠানকোট হামলার জেরে পাকিস্তান ঘেরাও হয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলির হাতে। তোপ দাগতে শুরু করেছে আমেরিকাও।

জইশ-ই-মহম্মদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে। ওই জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকটি দফতর সিল করে দিয়েছে ইসলামাবাদ। জইশ-প্রধান মৌলানা মাসুদ আজহারের গ্রেফতারি নিয়েও নানা জল্পনা। কিন্ত এই সবই পাকিস্তান করছে চাপে পড়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এখন ঘরে-বাইরে চাপের মুখে। দেশের ভিতরে সেনা, আইএসআই আর কট্টর ভারত-বিরোধী লবি নওয়াজকে চাপ দিচ্ছে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিতে। কিন্তু ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মন্তব্য, পাকিস্তান ‘সন্ত্রাসবাদীদের ভবিষ্যৎ স্বর্গ’। দুই প্রতিবেশী আফগানিস্তান আর শ্রীলঙ্কাও দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছে নওয়াজের দেশের সঙ্গে।

পঠানকোটে জঙ্গি হামলার কয়েক দিন পর নড়েচড়ে বসেছে পাকিস্তানের সরকার। নওয়াজ শরিফ নরেন্দ্র মোদীকে আশ্বাস দিয়েছেন, পাকিস্তানের মাটিকে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। কিন্তু নওয়াজের হাতে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মোটেই নেই। গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পাকিস্তানের কর্তৃত্ব নামেই। ইসলামাবাদের আসল চালিকাশক্তি সে দেশের সেনাবাহিনী। সেনার মতামতকে অগ্রাহ্য করে জইশ-ই-মহম্মদ, জামাত-উদ-দাওয়া বা লস্কর-ই-তৈবা’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সামর্থ্য নওয়াজের নেই। কারণ এই সব জঙ্গি সংগঠনকেই গড়ে তুলেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা না করে এই জঙ্গি সংগঠনগুলির আড়ালে মুখ লুকিয়ে ভারতে ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের সেনা। পঠানকোটে যে কায়দায় হামলা হয়েছে, তা জইশ কেন, আইএস-এর পক্ষেও নিজের ক্ষমতায় করা অসম্ভব। যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা হয়েছে, হামলাকারীদের জঙ্গিদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল, জইশের পক্ষে তার আয়োজন করা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই জইশ-সহ সব ভারত-বিরোধী জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অন্য সব রকমের সহযোগিতা দিচ্ছে। পাক সেনার বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনী স্পেশ্যাল সার্ভিস গ্রুপ বা এসএসজি-র উপর রয়েছে জঙ্গি সংগঠনগুলির আত্মঘাতী বাহিনী গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব। পঠানকোটের হামলাও যে এসএসজি-ই করিয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। যেখানে পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনা মাসুদ আজহার তথা জইশ-কে আগলে রেখেছে, সেখানে মাসুদ আজহারকে গ্রেফতার করার বা জইশকে খতম করার নির্দেশ দেওয়ার সাহস কী করে পাবেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ! ১৯৯৯ সালে সেই ভুল করে অনেক আফসোস করতে হয়েছে নওয়াজকে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফ নওয়াজের সরকারকে উল্টে দিয়ে কীভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তা নওয়াজ নিশ্চয়ই ভোলেননি।

তা হলে পাকিস্তান পঠানকোট কাণ্ডের তদন্তে নেমে যে সব ধরপাকড় চালাচ্ছে, তা কি নেহাৎই চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা? মোটের উপর বিষয়টা কিন্তু সে রকমই। জঙ্গি হামলার শিকার হয়ে ভারত যে ভাবে ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানকে, তা সামলানোও এখন নওয়াজের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক কী ভাবে পাকিস্তানকে ঘিরল ভারত?

ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চড়া মন্তব্য করেনি। কিন্তু নওয়াজ শরিফের সঙ্গে নিজে কথা বলে চাপ তৈরি করেছেন নরেন্দ্র মোদী। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল অকাট্য তথ্যপ্রমাণ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই হামলার পিছনে যে পাক সেনার হাত রয়েছে তা ভারতের কাছে স্পষ্ট। পাকিস্তানের উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে ভারত যে উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়ে নেবে, সে বার্তাও ইসলামাবাদকে শুনিয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।

এর পরের চাপ এসেছে ওয়াশিংটন থেকে। প্রথমে মার্কিন বিদেশ সচিব জন কেরি পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন। তার পর আমেরিকা জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানকে ৬টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার যে সিদ্ধান্ত আমেরিকা নিয়েছিল, তা বাতিল করা হচ্ছে। সব শেষে প্রেসিডেন্ট ওবামা সাফ বললেন, অদূর ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর সন্ত্রাসবাদীদের জন্য পাকিস্তান স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠতে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে পাকিস্তান সম্পর্কে এত কড়া শব্দ আগে কখনও শোনা যায়নি। আমেরিকা যখন মনে করছে পাকিস্তান সন্ত্রাসের বহু স্বর্গরাজ্য, তখন মার্কিন সেনা অভিযানের মুখে পড়ার আশঙ্কাও যে কোথাও না কোথাও থেকেই যাচ্ছে, তা নওয়াজ শরিফ খুব ভালই বুঝতে পেরেছেন।

আফগানিস্তান বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের অস্বস্তি। মাজার-ই-শরিফের ভারতীয় দূতাবাসে হামলা পাকিস্তানের সেনা আধিকারিকরাই ঘটিয়েছেন বলে আফগানিস্তানের সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এই দাবির পক্ষে কাবুল জোরালো প্রমাণও তুলে ধরেছে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে আরও মুখ পুড়েছে পাকিস্তানের।

আরও পড়ুন:

পঠানকোটের ‘বদলা’ নিল ভারতীয় হ্যাকাররা

পূর্ব সীমান্তে ভারত আর পশ্চিম সীমান্তে আফগানিস্তান খড়্গহস্ত। তাতেই বিড়ম্বনার শেষ নয়। আর এক বন্ধু দেশ শ্রীলঙ্কা হঠাৎ দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছে পাকিস্তানের সঙ্গে। চিনের কাছ থেকে কেনা টিইউ সিরিজের ফাইটার জেট পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাকে বিক্রি করবে বলে চুক্তি করেছিল। শ্রীলঙ্কা আচমকা জানিয়ে দিয়েছে, পাকিস্তানের কাছ থেকে ওই ফাইটার জেট তারা কিনবে না। সাউথ ব্লক সূত্রের খবর, কলম্বোর উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ালে ফল ভাল হবে না, ভারত সরকার চুপচাপ এই বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। সে দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনাও ভারতপন্থী। ফলে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন।

পাকিস্তান হঠাৎ করে একা হয়ে গিয়েছে। পঠানকোট জঙ্গি হামলার পর কোনও দেশ ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকী ঘনিষ্ঠ মিত্র চিনও কড়া ভাষায় নিন্দা করেছে পঠানকোট হামলার। তার মধ্যেই আচমকা পাকিস্তানের উপরেই উপর্যুপরি হামলা শুরু হয়েছে। আফগানিস্তানের জালালাবাদে পাক দূতাবাসে হামলা হয়েছে বুধবারই। পাকিস্তানের কোয়েটায় বড়সড় জঙ্গি হানায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের দফতরে গ্রেনেড হামলা হয়েছে। যদিও এই সব হামলার সঙ্গে ভারতের নাম এখনও জড়িয়ে দিতে পারেনি পাকিস্তান। তবু ভারত উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারে বলে ডোভাল যে হুঁশিয়ারি শুনিয়েছেন, সেই সতর্কবার্তা মাথা থেকে ঝেড়ে পেলতে পারছেন না নওয়াজ।

তাই এখন ধরপাকড়ের একটা ছবি তুলে ধরার মরিয়া চেষ্টা করছে নওয়াজ শরিফের সরকার। পঠানকোটে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে। জইশ-এর বেশ কিছু ঘাঁটি সিল করে দেওয়া হয়েছে বলেও খবর। কিন্তু মাসুদ আজহারকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সাজা দিয়ে দেবে, সে রকম ভাবার সময় আসেনি। আজহারকে গ্রেফতার এখনও করা হয়নি। যদি করা হয়ও, তা হলেও সেই গ্রেফতারির উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা দরকার। বিচার করার জন্য গ্রেফতার, না কি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য— তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়। মুম্বই হামলার পর জাকিউর রহমান লকভিকেও গ্রেফতার করেছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু সেই সেই গ্রেফতারি আসলে ছিল লকভিকে সুরক্ষিত রাখার তাগিদে। গোপন আস্তানায় পাঠিয়ে ফাইভ স্টার সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রাখা হয় লকভিকে। কড়া নিরাপত্তায় ঘিরে রাখা হয় তাকে। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাসুদ আজহারের ক্ষেত্রেও তেমন ব্যবস্থা হতেই পারে। যখনই পাকিস্তান বুঝতে পারে, গোপন অভিযান চালিয়ে এই জঙ্গি নেতাদের খতম করার চেষ্টা করতে চলেছে ভারত, তখনই তাদের গ্রেফতার করার নামে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যদি চায়, এখনই মৃত্যুদণ্ড হয়ে যেতে পারে মাসুদের। কিন্তু সেনা না চাইলে, নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা নেই তার কেশাগ্র স্পর্শ করার।

নওয়াজ হয়তো শান্তিই চাইছেন। পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের বিরাট অংশ ভারতের সঙ্গে শত্রুতার অবসান চায়। ঠিক যেমন ভারতও চাইছে। কিন্তু পাক সেনাবাহিনীর কর্তারা তার জন্য এখনও প্রস্তুত নন। এখন নওয়াজ শরিফকে প্রমাণ করতে হবে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার আসল কেন্দ্র কে? তিনি? নাকি সেনাপ্রধান রাহিল শরিফ?

পরিস্থিতি যা-ই হোক, দু’দেশের কথা জারি থাকা উচিত বলে ওয়াকিবহাল মহলের সকলেই মনে করছেন। তবে তার জন্য আক্রান্ত হয়েও সুর চড়ানো যাবে না, এমনটা চলতে পারে না। আমরা যাঁরা ভারতীয় সেনা পরিবারের প্রবীণ সদস্য, তাঁরা মাঝেমধ্যে হতাশ হই। আমেরিকা বলে, আমাদের কেউ আঘাত করলেই আমরা পাল্টা আঘাত করব। ইজরায়েল বলে, আমাদের যে আঘাত করবে, তাকে আমরা মুছে দেব। ভারত বলে, আমাদের আঘাত করলে ক্রিকেট খেলব না। এই নীতি চলতে পারে না। নিজেকে সুপার-পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে, সুপার-পাওয়ারের মতোই আচরণ করতে হবে ভারতকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর অবশ্য সেই নতুন পথে হাঁটতে শুরু করার আভাস দিয়েছেন। পঠানকোট হামলার প্রেক্ষিতে তাঁর মন্তব্য, আমাদের উপর যারা হামলা করবে, তাদের আমরা উপযুক্ত জবাব দেব। ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় ভারত এর জবাব দিয়ে দেবে। হুঁশিয়ারি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর। অনেক দিন পর কোনও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর মুখে এমন বলিষ্ঠ মন্তব্য শুনে ভালই লেগেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE