তিন কৌশলে পাকিস্তানকে বিদ্ধ করতে সক্রিয় হল ভারত। বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর সাংবাদিক বৈঠকে পরপর প্রসঙ্গগুলি সামনে আনা হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, প্রথমত, সীমান্তে সংঘাতের আবহে যাত্রিবাহী বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। দ্বিতীয়ত, ভারতে অস্থিরতা ছড়াতে সীমান্ত এলাকায় থাকা গির্জা ও গুরুদ্বারকে পরিকল্পিত ভাবে নিশানা করা হচ্ছে। এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের সঙ্গে জঙ্গি সংশ্রবের অভিযোগ নিয়েও সরব হন তিনি। গতকাল বিদেশসচিব একটি ছবি দেখিয়ে দাবি করেছিলেন, লস্কর কমান্ডার হাফিজ় আব্দুল রউফ জঙ্গিদের শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছেন পাক সেনাকর্তারা। আজ সেই রউফের সঙ্গে আমেরিকার সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের যোগের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি।
পর্যবেক্ষকদের তরফে মনে করা হচ্ছে, এই ভাবে ভারত গোটা বিশ্বের কাছে যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চাইছে, সেটা হল এই: সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অপারেশন সিঁদুর চালিয়েছে দিল্লি, যার লক্ষ্য কোনও নাগরিক বা সামরিক এলাকা নয়, শুধু জঙ্গিঘাঁটি। অথচ, তার পাল্টা হিসাবে পাকিস্তান ছলে বলে কৌশলে ভারতের উপরে হামলা চালাতে চাইছে। এবং তারা যে সন্ত্রাসবাদীদের পাশ থেকে সরেনি, সেটাও ছবিতে স্পষ্ট।
বিদেশসচিবের আরও বক্তব্য, পহেলগামে জঙ্গি হানার সময়ে সন্ত্রাসবাদীরা যেমন পর্যটকদের জাতধর্ম জেনে গুলি করেছে, তেমনই হামলার সময়েও বেছে বেছে ভারতীয় সীমান্তে থাকা গির্জা ও গুরুদ্বারকে নিশানা করছে পাকিস্তান। তাঁর কথায়, ‘‘গত ৭ মে ভোরে পুঞ্চ সীমান্তে পাকিস্তানের দিক থেকে গোলাবর্ষণের সময়ে একটি গোলা সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় থাকা কারমেলাইটস অব মেরি ইম্যাকুলেট দ্বারা পরিচালিত ক্রাইস্ট স্কুলের ঠিক পিছনে এসে পড়ে। দুঃখজনক ভাবে পাকিস্তানের ছোড়া গোলা স্কুলের দুই ছাত্রের বাড়িতে আঘাত করে। তারা দু’জনেই প্রাণ হারায়। গুরুতর আহত হন তাঁদের বাবা-মায়েরা। আর একটি গোলা কারমেলের খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের কনভেন্টে এসে পড়ে। এতে জলের ট্যাঙ্ক ও সৌর প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময়ে স্কুলকর্মী, সন্ন্যাসিনী, স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ স্কুলের নীচে থাকা একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় নেওয়ায় বেঁচে যান। স্কুলটি বন্ধ না থাকলে আরও বড় ক্ষতি হতে পারত।’’
বিক্রমের কথায়, ‘‘গোলার শিকার হয়েছে একটি গুরুদ্বার এবং মন্দিরও। প্রথমে পহেলগাম হামলা ও তার পরে গোলাবর্ষণের ঘটনাতেও সমাজের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে সক্রিয় রয়েছে পাকিস্তান।’’ নয়াদিল্লির দাবি, পাকিস্তানের ওই পদক্ষেপ দেখে তারা আদৌ অবাক নয়। কারণ, ভারতবাসীর অভ্যন্তরীণ ঐক্য পাকিস্তানের জন্য বরাবরই চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে কর্তারপুর করিডর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও দাবি মিস্রীর। ফলে এখন আর দরবার সাহিব গুরুদ্বারে যেতে পারবেন না দর্শনার্থীরা।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি, সে দেশের ভাবমূর্তি খারাপ করতে ভারত পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের শহরে হামলা চালাচ্ছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, ড্রোনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশে থাকা নানকানা সাহিব গুরুদ্বারে হামলা চালাচ্ছে ভারত। ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বিক্রম বলেন, ‘‘আমরা আমাদের নিজেদের শহরে আক্রমণ করব, এমন পাগলের প্রলাপ কেবল পাকিস্তানই করতে পারে। এমনটি সম্ভবত তারাই করতে পারে। কারণ, ওই দেশের ইতিহাস সেই কথাই বলে।’’
ভারত-পাকিস্তান সীমানে যখন তীব্র গুলি বিনিময় চলছে, সেই সময়ে ভারতের হানা ঠেকাতে যাত্রিবাহী বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করছে— এই অভিযোগে ওই একই সাংবাদিক বৈঠক থেকে সরব হয়েছেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। তাঁরা দাবি করেন, গত ৭ মে সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ বিনা প্ররোচনায় ভারত লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় পাকিস্তান। অথচ, সীমান্তে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলেও পাকিস্তান তাদের আকাশসীমায় বেসরকারি বিমান চলাচলে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। ব্যোমিকা বলেন, ‘‘ভারত যে পাল্টা হামলা করবে, তা জানা সত্ত্বেও আকাশসীমা বন্ধ না করে উল্টে বেসরকারি বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করে পাকিস্তান।’’
ভারতীয় সেনা আজ ফ্লাইটরেডার ২৪ অ্যাপ্লিকেশন-এর তথ্য তুলে ধরে দেখিয়েছে, সংশ্লিষ্ট দিনে ওই সময়ে ভারতের পঞ্জাব সেক্টরে বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও, পাকিস্তান আকাশসীমা খোলা ছিল। তখন ফ্লাইনাস অ্যাভিয়েশনের একটি এয়ারবাস ৩২০ সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে ৫টা ৫০ মিনিটে যাত্রা শুরু করে রাতে এগারোটা নাগাদ লাহোরে অবতরণ করে। সেনার দাবি, পাকিস্তান যাত্রিবাহী বিমানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে বুঝতে পেরে নিজেদের পাল্টা হামলায় যথেষ্ট সংযম প্রকাশ করে ভারত। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনও ভাবে ভারতের পক্ষ থেকে হওয়া হামলায় যদি কোনও যাত্রিবাহী বিমান দুর্ঘটনাগ্রস্ত হত, তা হলে বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সুযোগ পেয়ে যেত পাকিস্তান। সম্ভবত সেই কারণে আকাশসীমা খোলা রেখে যাত্রী বিমানগুলিকে মানব-ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। এ দিকে সীমান্ত উত্তেজনার বিষয়টি মাথায় রেখে ভারতের ৩২টি বিমানবন্দর প্রথমে ৯ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছিল। আজ তা বাড়িয়ে ১৫ মে ভোর পর্যন্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ নিহত জঙ্গিদের শেষকৃত্য পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় করছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাজির রয়েছেন পাকিস্তানের সামরিক অফিসারেরাও। মিস্রীর বক্তব্য, ‘‘তথাকথিত সাধারণ নাগরিকদের কফিন পাক পতাকায় মোড়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য হচ্ছে। যে ঘাঁটিগুলিতে আঘাত হানা হয়েছিল, তাতে জঙ্গিরা ছিল বলে মনে করি। জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য পাকিস্তানে প্রচলিত ব্যবস্থা হতে পারে। আমাদের কাছে তা অর্থহীন।’’
পাকিস্তানের সঙ্গে তীব্র উত্তেজনার মধ্যে সীমান্ত পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। এর আগে, বৃহস্পতিবার সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আজ সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পরে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করের সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। তার আগে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদী, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অনিল চৌহান, নৌসেনা প্রধান দীনেশ ত্রিপাঠী, বায়ুসেনা প্রধান এপি সিংহ-সহ সেনার শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)