E-Paper

৪০০ ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র রুখেই এল সাফল্য

সেনার দাবি, দেশের সীমান্তে কোথায়, কী ধরনের ‘এয়ার ডিফেন্স রেডার’ ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে— সেই তথ্য সংগ্রহ ও সেই রেডারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতেই ওই বিশাল সংখ্যায় ড্রোন পাঠায় পাকিস্তান।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৮:৪৯

— প্রতীকী চিত্র।

যুদ্ধ যেন অনেকটাই হয়েছে ড্রোনে-ড্রোনে। পাকিস্তানের দিক থেকে উত্তর-পশ্চিমের লে থেকে শুরু করে পশ্চিমের গুজরাতের স্যর ক্রিক— গোটা উত্তর পশ্চিম ও পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে বৃহস্পতিবার রাতে অন্তত ৩৬টি জায়গায় হামলার লক্ষ্যে ৩০০-৪০০টি ড্রোন উড়ে এসেছে। পুরো হামলাই সাফল্যের সঙ্গে সামলে দিয়েছে ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারিতে থাকা ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে সম্প্রতি পাশ কাটাতে সক্ষম হয়েছে হামাস। কিন্তু গত দু’রাতে ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা রুখে দিয়েছে পাকিস্তানের যাবতীয় হামলা।

সেনার দাবি, দেশের সীমান্তে কোথায়, কী ধরনের ‘এয়ার ডিফেন্স রেডার’ ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে— সেই তথ্য সংগ্রহ ও সেই রেডারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতেই গতকাল ওই বিশাল সংখ্যায় ড্রোন পাঠায় পাকিস্তান। পাল্টা হামলায় পাকিস্তানের চারটি বিমান প্রতিরক্ষা কেন্দ্র লক্ষ্য করে ড্রোন পাঠায় ভারত। যা প্রতিবেশী দেশের একটি ‘এয়ার ডিফেন্স রেডার’কে শনাক্ত করে, তা নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ দিকে আজ রাতে ফের পাকিস্তানের ড্রোন হামলার খবর এসেছে সাম্বা, জম্মু ও পঠানকোট, ফিরোজপুর-সহ একাধিক জায়গা থেকে।

এমন ড্রোনে-ড্রোনে যুদ্ধ নতুন নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে দু’শিবিরই হামলা চালাতে মূলত ভরসা রেখেছে ড্রোনের উপরে। কম খরচে, মানববিহীন প্রযুক্তির মাধ্যমে রেডারের নজর এড়িয়ে হামলা চালিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ড্রোনের বিকল্প নেই। কিন্তু চলতি সংঘাতের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হল, গত দু’রাতে পাকিস্তান যে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে, তার প্রত্যেকটিই রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, ‘আয়রন ডোম’ বা আকাশে ছাতার মতো থাকা প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকা ইজ়রায়েলের প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে হামলা চালাতে সক্ষম হয় হামাস। কিন্তু বুধবার ও বৃহস্পতিবার রাতে যে জায়গাগুলি লক্ষ্য করে হামলা চালায় পাকিস্তান, তার প্রতিটিই নিখুঁত ভাবে প্রতিহত করেছে ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা।

ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থার শিকার হয়েছে চিন নির্মিত একাধিক পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রও। যার মধ্যে আজ একটি প্রায় দু’টুকরো অবস্থায় উদ্ধার হয় পঞ্জাবের হোসিয়ারপুরে। ভারতের আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে পাকিস্তানের দু’টি জে এফ-১৭ চিন যুদ্ধবিমান। ভারত ওই যুদ্ধবিমান নামানোর দাবি না করলেও, পাকিস্তানের সেনাকর্তারা সাংবাদিক সম্মেলনে সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।

ভারতের আকাশকে নিরাপদ করার পিছনে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মূলত কৃতিত্ব দিচ্ছেন রাশিয়ার এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থাকে। ওই আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থার ভারতীয় নাম ‘সুদর্শন চক্র’। এই ব্যবস্থায় তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে ৩৬০ ডিগ্রিতে নজরদারি চালাতে সক্ষম একটি রেডার। যা যে কোনও ড্রোন, বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, আত্মগোপনে সক্ষম বিমানকে ছ’শো কিলোমিটার দূর থেকে চিহ্নিত করে ফেলতে সক্ষম। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তের ও-পার থেকে ক্ষেপণাস্ত্র বা বিমান উড়লেই সেই সঙ্কেত ধরা পড়ে ওই ব্যবস্থার রেডারে। যা তৎক্ষণাৎ হামলাকারী বস্তু সম্পর্কে বার্তা পাঠায় ‘কম্যান্ড ভেহিকল’কে। পরবর্তী ধাপে সেই বার্তা পৌঁছয় ‘এনগেজমেন্ট রেডারে’। তা থেকে ‘লঞ্চার ভেহিকলে’। এনগেজমেন্ট রেডার উড়ন্ত বস্তুর গতির ভিত্তিতে নিশানা স্থির করে দিতেই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ওই ব্যবস্থা। শত্রু বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে এ যাত্রায় একবারও ব্যর্থ হয়নি এস-৪০০। আকাশ পথে হামলা রোখার প্রশ্নে এ যাত্রায় বিশেষ সাফল্য পেয়েছে ভারতের নিজের তৈরি ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ‘আকাশ’। এই প্রথমবার এমন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করল সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের পাঠানো ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে ব্যবহার হয়েছে ইজ়রায়েলের বারাক-৮ ক্ষেপণাস্ত্রও।

তবে ড্রোন হামলা রুখতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে বফর্স সংস্থার তৈরি এল-৭০ বিমান বিধ্বংসী শস্ত্র। স্বল্প উচ্চতায় উড়তে থাকা কোনও ড্রোনকে নিখুঁত ভাবে ধ্বংস করতে ৪০ মিলিমিটারের ওই বন্দুক কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে। ভারতীয় সেনা জানিয়েছে, শত্রু ড্রোনকে আকাশে চিহ্নিত করে সেগুলি ‘জ্যাম’ করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ম্যান পোর্টেবল কাউন্টার ড্রোন সিস্টেম (এমপিসিডিএস)। কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে (আবাসন, সামরিক পরিকাঠামো, বিমানবন্দর) শত্রুর হামলা থেকে বাঁচাতে ওই ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়েছে পশ্চিম সীমান্তে। ওই ব্যবস্থার সুবিধা হল, হাল্কা ওই প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে প্রয়োজনে এক জন প্রশিক্ষিত ব্যক্তিও চালাতে পারেন।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্রোন রেডারে ধরা পড়লেই ওই ব্যবস্থা শত্রু ড্রোনের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ‘জ্যাম’ বা বাধাপ্রাপ্ত করে। যোগাযোগ বার্তা না পৌঁছানোয় দিকভ্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায় শত্রু ড্রোন। সূত্রের মতে, মূলত জম্মু, পঞ্জাব সীমান্তে ওই ব্যবস্থা সক্রিয়। ফলে জম্মু, ভাটিন্ডা কিংবা অমৃতসর লক্ষ্য করে পাকিস্তান ড্রোন পাঠালেও তা আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়।

আজ সাংবাদিক সম্মেলনে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ জানিয়েছেন, পাকিস্তানের পাঠানো ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে, এগুলি তুরস্কের অ্যাসিসগার্ড সোনগার ড্রোন। সেনা জানিয়েছে, ড্রোন হামলা ছাড়াও গত রাতে পাকিস্তানের একটি আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকাল (ইউএভি) পঞ্জাবের ভাটিন্ডার সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলার চেষ্টা চালালে সেটিকেও সফল ভাবে নিষ্ক্রিয় করা হয়।

গত কাল রাতভর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের উরি, পুঞ্চ, মেন্ধার, রাজৌরি, আখনুর ও উধমপুর লক্ষ্য করে বড় আকারের অস্ত্র ব্যবহার করে গোলাগুলি ছুড়েছে। ফলে স্থানীয় জনতা ও ভারতীয় সেনার কিছু সংখ্যক জওয়ান হতাহত হয়েছেন। পাল্টা হামলায় পাক সেনার বিপুল ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত।

এরই মাঝে গত রাতে গোলাগুলি চলার সুযোগ নিয়ে সাম্বা সেক্টরের আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গিদের একটি দল ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। যাদের উপস্থিতি ধরে ফেলে বিএসএফ। পাল্টা হামলা চালালে মারা যায় সাত জঙ্গি। ওই জঙ্গিদের অনুপ্রবেশে সাহায্য করতে সীমান্তের অপর প্রান্তে থাকা একটি বাঙ্কার থেকে গুলি চালাচ্ছিল পাকিস্তানি রেঞ্জার্সরা। বিএসএফ জানিয়েছে, তাঁদের প্রত্যাঘাতে রেঞ্জার্সের ধনধর পোস্টটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Operation Sindoor India-Pakistan Air Defense System

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy