Advertisement
E-Paper

দেশের অভিধান থেকে ‘দারিদ্র’ শব্দটা মুছে দিতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা

সাদা কুর্তা ও মেখলা পরনে। একেবারেই ঘরোয়া পোশাকে ইন্দিরা এলেন। স্মৃতিচারণে দেবপ্রসাদ রায়সাদা কুর্তা ও মেখলা পরনে। একেবারেই ঘরোয়া পোশাকে ইন্দিরা এলেন। স্মৃতিচারণে দেবপ্রসাদ রায়

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০০:২৯
ইন্দিরাজি জানতেন, দল হয়তো একশো শতাংশ তাঁর সঙ্গে নেই, কিন্তু দেশ তাঁর সঙ্গে আছে। অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

ইন্দিরাজি জানতেন, দল হয়তো একশো শতাংশ তাঁর সঙ্গে নেই, কিন্তু দেশ তাঁর সঙ্গে আছে। অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

আকাশের তারাদের যেমন গোনা যায় না, সমুদ্রের গভীরতা যেমন মাপা যায় না, মহাকাশের সীমানা যেমন খোঁজা যায় না, স্বল্প পরিসরে ইন্দিরাজিরও মূল্যায়ন করা যায় না। কত দূর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন বা কত দূর ডিগ্রি নেওয়ার প্রচেষ্টায় থেকেছেন তা ইন্দিরাজির কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল না। কারণ দেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ‘দার্শনিক–রাজনীতিবিদ’ ছিলেন তাঁর পিতা। তার পত্রাবলি ও ব্যক্তিগত সান্নিধ্য ইন্দিরাজিকে যে প্রজ্ঞা দিতে সক্ষম হয়েছিল, তার প্রয়োগ করেই তিনি ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ হতে পেরেছিলেন, দেশের মানুষের কাছে ‘মা’ হয়ে বন্দিত হয়েছিলেন। তবে এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, তিনি প্রথাগত শিক্ষার পরিসরে কখনও আসেননি। ছ’বছর বয়সে সিসিলিয়া পাবলিক স্কুলে, ন’বছর বয়সে সেন্ট মেরি কনভেন্ট স্কুলে এবং তার পরবর্তীতে পিপল্‌স্‌ ওন স্কুলে অধ্যয়ন করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শান্তিনিকেতনে এসে স্নাতক স্তরের পাঠ নিয়েছিলেন। যদিও পরে লন্ডনে অক্সফোর্ডের সামারভিল কলেজে পড়ে স্নাতকস্তরের অধ্যয়ন শেষ করেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাত্রাটা কণ্টকাকীর্ণ ছিল বলাই শ্রেয়। কারণ, ’৬৬ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে ভাইজ্যাগ স্টিল প্ল্যান্টের জন্য রাজ্য জুড়ে হিংসাত্মক আন্দোলন এবং তার রেশ শেষ না হতেই দিল্লিতে গো-হত্যা বন্ধের দাবিতে সাধুদের হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন, যার ফলে দিল্লিতে ৪৮ ঘণ্টা কারফিউ জারি করতে হয়েছিল– এ সবের মধ্য দিয়েই তাঁকে দায়িত্বভার সামলাতে হয়। তার পরে ৯টি রাজ্যে নির্বাচনী বিপর্যয়। এবং ’৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই বিহারে এক দিকে আকাল, অন্য দিকে বন্যা। তখনও পি এল ৪৮০-র দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। সেখান থেকে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর ভেতর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো, অন্ধ্রপ্রদেশের আন্দোলন ও গো-হত্যা নিবারণ আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক বার্তা তাঁকে পথ চিনতে সাহায্য করেছিল।

দিল্লিতে বাণিজ্য মেলায় শ্রীমতি গাঁধী।

দু’বছর অপেক্ষা করে ’৬৯-এ বাঙ্গালোর অধিবেশনে তাই দূরদর্শিতার নজির স্থাপন করে বলতে পেরেছিলেন, ‘Time will not wait for us, millions of people who demand job, food and shelter are pressing for action.” অ্যাকশন শুরু হল। ’৬৯-এ ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হল, ’৭১-এ রাজন্যভাতা বিলোপ হল, ’৭৩-এ ৪৪৬টি কয়লাখনি জাতীয়করণ হল এবং পরবর্তীতে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলিরও জাতীয়করণ হল। যদিও রাজন্যভাতা বিলোপের সিদ্ধান্ত ’৭০ সালেই ঘোষণা করা হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্তকে মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে বাতিল করে দেয়। মনে আছে, তখন প্রিয়দা (প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি) কলকাতা থেকে পোস্টার পাঠিয়েছিলেন, ৫০ কোটি মানুষের জয়যাত্রা আদালত স্তব্ধ করতে পারবে না। নির্বাচনের পর ’৭১ সালে ২৬তম সংবিধান সংশোধন করে এই সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা হয়।

’৬৭–তে গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন প্রায় পাঁচ শতাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রাণ হারান তখন তিনি প্রশাসনিক মোকাবিলার পাশাপাশি ডঃ জাকির হুসেনকে রাষ্ট্রপতি পদে ও হেদায়তুল্লা সাহেবকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি করে আক্রান্ত মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

‘গণতান্ত্রিক সমাজবাদ’ কংগ্রেসের আদর্শ, ’৬৪-তে ভুবনেশ্বর কংগ্রেস অধিবেশনে নেহরুজি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার প্রয়োগ করেছিলেন ইন্দিরাজি। দলের ভেতর থেকে প্রতিরোধ ছিল। তাই স্বল্প পরেই তথাকথিত সিন্ডিকেট (মোরারজী, এস কে পাতিল, অতুল্য ঘোষ প্রমুখ) রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে দলের ভেতর শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ইন্দিরাজির মতের বিরুদ্ধে নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে প্রার্থী করে ইন্দিরার ওপর চাপিয়ে দিল। তবুও তিনি কিন্তু দলের বিভাজন চাননি। তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে ভি ভি গিরিকে তোমরা উপরাষ্ট্রপতির জন্য যোগ্য মনে করলে, তাঁকে রাষ্ট্রপতি করতে আপত্তি কোথায়! কিন্তু তাঁদের অন্য অভিসন্ধি ছিল। তাঁরা সঞ্জীব রেড্ডিকে দিয়ে ইন্দিরাজিকে অপসারিত করবার ফন্দি আঁটছিলেন। ইন্দিরাজি জানতেন, দল হয়তো একশো শতাংশ তাঁর সঙ্গে নেই, কিন্তু দেশ তাঁর সঙ্গে আছে। তাই বিবেকের ভোটের আহ্বান জানিয়ে ভি ভি গিরিকে তিনি যখন প্রার্থী ঘোষণা করলেন, তখন লোকসভার সমস্ত প্রগতিশীল অংশ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রার্থীকে জয়ী করে দেশের মানুষকে একটা বার্তা দিলেন, যারা ইতিহাসের চাকা পেছনদিকে ঘোরাতে চায়, দেশ তাদের বর্জন করে।

আমরা যেন একটা দিশা পেলাম। দল যে কথাগুলি সময়ে সময়ে এক একটা অধিবেশনে প্রস্তাব আকারে শুধু বলে গেছে, ইন্দিরাজি তা একের পর এক বাস্তবায়িত করে, কংগ্রেসের পুরনো পরম্পরাকে ফিরিয়ে আনলেন— মানুষকে বাদ দিয়ে দল নয়, মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন দলের ভেতর যদি না থাকে তা হলে দল মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। মানুষ চেয়েছিল বলেই কংগ্রেস ‘হোমরুল’ চেয়েছিল, মানুষ চেয়েছিল বলেই ‘পূর্ণ স্বরাজ’ চেয়েছিল, আর মানুষ চেয়েছিল বলেই অহিংসার পূজারী গাঁধীজিকে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ বলতে হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে, তমলুক, সাতারা, বালিয়াতে বিকল্প সরকার গড়তে হিংসার আশ্রয় নিতে কংগ্রেস পিছপা হয়নি । সেই মানুষ কী চাইছে, সবচেয়ে ভাল ইন্দিরাজি বুঝতেন বলেই ’৬৯-এ দলের অচলায়তনকে ভেঙে নতুন চেহারায় দলকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে, একের পর এক প্রগতিশীল কর্মসূচির ভেতর দিয়ে ’৬৭-এর হারিয়ে যাওয়া আস্থা আবার পুনরুদ্ধার করতে শুরু করলেন।

বিশ্বভারতীতে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন।

বিভাজনের ফলশ্রুতিতে লোকসভায় তিনি সংখ্যালঘু । কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাহস হয়নি অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবার চেষ্টা করার। ’৭১-এর নির্বাচন এল। বিরোধীদের শ্লোগান উঠল, ‘ইন্দিরা হঠাও’। ইন্দিরাজি শ্লোগান দিলেন, ‘গরিবি হঠাও’। ৩৫৪ জন সদস্য নিয়ে লোকসভায় ফিরে এলেন তিনি। অব্যবহিত পরেই পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হল স্বাধীনতার যুদ্ধ। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে, দূরদর্শী ইন্দিরাজি এক দিকে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, অন্য দিকে পৃথিবীর দেশগুলিকে, বিশেষ করে শক্তিধর দেশগুলিকে, বোঝাবার কাজ শুরু করলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে ‘জেনোসাইড’ চলছে তা মানবতা বিরোধী এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে এই নরসংহার থেকে বিরত করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে । চট্টগ্রাম, বরিশালে বাঘা সিদ্দিকীরা লড়াই করেছেন, কিন্তু রাজশাহি, পাবনা, বগুরা, রংপুর— আমরা জানি, অসামরিক পোশাকে যদি বিএসএফ মুক্তি বাহিনীর ভূমিকা পালন না করত তা হলে বাংলাদেশ হয়তো অন্য কোনও ইতিহাস লিখত। জানতেন, আমেরিকাকে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ’৭১-এর অগস্টে রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি করে একটা সুপার পাওয়ারকে সঙ্গে রাখা নিশ্চিত করলেন। জানি না, এটা কাকতলীয় কি না, ৪ঠা ডিসেম্বর ইন্দিরাজি কলকাতায় ব্রিগেডে সভা করছেন, আর পাকিস্তানি বায়ুসেনারা কলাইকুণ্ডায় বোমাবর্ষণ করল। ব্রিগেড থেকেই ইন্দিরাজি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। মাত্র বারো দিন। ৮৬ হাজার সেনা নিয়ে নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলেন। নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হল। ইতিহাসে এই নজির বোধহয় আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না, একটা দেশ স্বাধীন করে দিয়ে ঘোষিত সময়সীমার ভেতর শেষ ভারতীয় সেনাটিও বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে চলে এল।

আরও পড়ুন: এই ভারত ইন্দিরারই

’৬৬-র খাদ্য আন্দোলন থেকে আজ খাদ্যসুরক্ষা প্রকল্প— অনেক পথ হাঁটতে হয়েছে দেশকে। পি এল ৪৮০-তে যে গম আনতে আমেরিকার কাছে মাথা নিচু করতে হত, সেখান থেকে দেশকে ইন্দিরাজিই রেহাই দিয়েছিলেন। হয়তো নেহরুজির মতো আন্তর্জাতিক তিনি হতে পারেননি। কিন্তু তিনিই প্রথম স্লোগান তুললেন যে, পৃথিবীতে ‘ New International Economic Order‘ মেনে সবাইকে চলতে হবে। সাম্য’ই হবে বৈদেশিক সাহায্যের ভিত্তি। প্রকৃতি কোন দেশকে অনেক দিয়েছে, কোন দেশকে দিতে কার্পণ্য করেছে, তার অর্থ এই নয়, যার কম আছে তাকে যার বেশি আছে, তার কাছে মাথা বিক্রি করে সাহায্য চাইতে হবে। প্রকৃতির দানের উপর গোটা পৃথিবীর মানুষের সমান অধিকার আছে। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি ১৯৮১ সালে কানকুনে ‘নর্থ সাউথ ডায়ালগ’ শুরু করেছিলেন। পরে এই তত্ত্বই জোটনিরপেক্ষ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ১৯৮৩ সালে তাঁর সভাপতিত্বে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষিত হয়েছিল। পথ দেখিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু, আর সে পথে অটল ছিলেন ইন্দিরা গাঁধী। ’৭৪-এ পোখরান বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, ‘ননপ্রলিফারেশন ট্রিটি’তে স্বাক্ষর না করে ইন্দিরাজি শুধু দেশের মাথা উঁচু করেননি, তৃতীয় বিশ্বের শতাধিক ছোট দেশকে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।

আজ ইন্দিরা গাঁধী নেই, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুধু স্তিমিত হয়ে গিয়েছে তা-ই নয়, ভারত সে পথকে পরিত্যাগ করবার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই গোয়ার ব্রিক্স সম্মেলনে আমেরিকার প্রতি অতিশয় আতিশয্য দেখিয়ে পুরনো বন্ধু পুতিনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতের পরিচয় ছিল তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে । কারণ জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নেহরু, ইন্দিরাকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে বিভিন্ন সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সহমর্মিতা জানাতে কার্পণ্য করেনি। আজ তারা পাশে নেই, কারণ আজ ইন্দিরা গাঁধীই নেই।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এক অর্থে ছিল গাঁধীবাদের আন্তর্জাতিকীকরণ। তাই ইন্দিরাজির প্রয়াণে ভারত কেবল এক জন নেত্রীকে হারায়নি, আন্তর্জাতিক আঙিনায় এ দেশ প্রদর্শিত গাঁধীবাদের অবলুপ্তি হতে দেখছে । পোখরান বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেও যে দেশ আন্তর্জাতিক স্তরে ভারসাম্যের রাজনীতিতে কখনও একাকিত্ব বোধ করেনি, আজ সেই দেশ সঙ্গীহীন হয়ে উরিতে, পাঠানকোটে অথবা কখনও অগ্নিগর্ভ কাশ্মীরে সমাধানের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে।

বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই?— দেশের বাইরে, দেশের ভেতরে, কোথাও তিনি থেমে থাকেননি। সামন্ততান্ত্রিক ভারতে মূল শোষণ যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ভূমিহীন, ক্ষেতমজুর ও প্রান্তিক চাষিদের বঞ্চনার শিকার করে রেখেছিল, সেখানে তিনি আঘাত করেছিলেন শোষণের বিরুদ্ধে, শোষককে। তাই তাঁর বিশ দফা কর্মসূচিতে ভূমিহীনকে জমির অধিকার, গৃহহীনকে বাসস্থানের অধিকার, কর্মহীনকে রোজগারের অধিকার, ঋণগ্রস্ত মানুষকে মহাজনী শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার অধিকার দিয়ে জাতপাতের ভারতবর্ষে, ধর্মের ধ্বজা তুলে বিভাজনের রাজনীতির ভারতবর্ষে, মানুষকে একটা বিকল্প পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন, তুমি হরিজন নও, তুমি গরিব, তুমি আদিবাসী নও, তুমি গরিব, তুমি তফসিলি নও, তুমি গরিব, তুমি মুসলমান নও, তুমি গরিব, তুমি হিন্দু নও, তুমি গরিব। তোমার লড়াই মসজিদ ভাঙার নয়, তোমার লড়াই শোষণের শৃঙ্খল ছেঁড়ার।

জরুরি অবস্থা বা জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন নিয়ে লিখতে বসিনি। আজ নতুন করে লিখবার প্রয়োজন নেই, কেন জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। আজ নতুন করে বলবার দরকার নেই, জয়প্রকাশের আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল। সে দিন সিপিআই-ই বলেছে এই আন্দোলন ফ্যাসীবাদী আন্দোলন। এই প্রতিক্রিয়ার বাতাবরণে কি বলতে পারি, দুই উগ্রপন্থী শিখ নয়, যে শক্তি বাংলাদেশে মুজিবকে হত্যা করেছে, সিংহলে সিরিমাভো বন্দরনায়েককে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, পাকিস্তানে ভুট্টোকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছে, সেই শক্তির হাতেই কি বলি হয়েছিলেন ইন্দিরাজি, ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর?

১৯ নভেম্বর থেকে ইন্দিরাজির শতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে দেশ জুড়ে। কাকতলীয় ভাবে হত্যার ক’দিন আগেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, ডাক্তাররা ইন্দিরাজির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, তাঁর বয়সে যে প্রোফাইল পাওয়া গেছে তা অবিশ্বাস্য। অর্থাৎ, আরও বহু দিন বেঁচে থাকার জীবনীশক্তি ছিলো তাঁর। দেশের অভিধান থেকে ‘দারিদ্র’ শব্দটাকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, তাই সামন্ততান্ত্রিক দেশে তাঁকে সময় হওয়ার আগেই চলে যেতে হল।

একটা অসমর্থিত তথ্য অনেক দিন ধরেই ইন্দিরাজিকে নিয়ে প্রচার করবার চেষ্টা চালু আছে। তা হল, নেহরুজিই চাইতেন। তার পর ইন্দিরাজি দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। বস্তুত ইন্দিরাজীর রাজনীতিতে পদার্পণ গাঁধিজির উদ্যোগে । তিনিই প্রথম ’৪৭ সালে দাঙ্গা বিধ্বস্ত দিল্লীতে ত্রাণকার্য্যে আত্মনিয়োগ করবার জন্য ইন্দিরাজিকে উৎসাহিত করেন । যদিও তার আগেই ’৪২ সালে একবার কারাবরণ করা হয়ে গেছে।

’৫৯ সালে এ.আই.সি.সি. সভাপতির পদ গ্রহণ করবার জন্য গররাজি ইন্দিরা গাঁধীকেকে রাজি করিয়েছিলেন পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ । আর ’৬৪ সালে নেহরুজির মৃত্যুর পর লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাঁকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলেন। ’৬৬-তে যাঁরা ওনাকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন তাঁরা জানতেন মোরারজিকে ঠেকাতে ইন্দিরা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। তাই তাঁর জীবনের প্রতিটি উত্তরণ নিজস্ব কারণে। সেখানে কোথাও নেহরুজির কোনও ভূমিকা নেই।

আমার দিল্লীর যুব কংগ্রেসের সাত বছর আমার জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়। এবং সাফল্যেরও সময় বললে ভুল হবে না। এই উত্থানের পেছনে রাজীবজির অকৃত্রিম সমর্থন ও প্রশয় যেমন কাজ করেছে, তেমনই সহকর্মীদের ভেতরও কেউ কেউ, বিশেষ করে প্রথম বছরগুলিতে পাশে দাঁড়িয়ে সাহস ও সাহায্য জুগিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে পানিক্কর ও গুলাম নবির অবদান ভোলবার নয়। দিল্লিতে চলাফেরা, থাকা খাওয়ার সংকটে পানিক্কর যেমন সহযোগিতা করেছে, তার পরবর্তীতে ওর খেয়াল থাকত, সময় যখন বদলাচ্ছে, সবার সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে তখন মিঠু (ও’ ও আমায় মিঠু ডাকতো) যেন এর বাইরে না থাকে। ফলে ওর সৌজন্যে পাঁচতারা হোটেল চিনলাম, দূতাবাসগুলি চিনলাম। আবার বিভিন্ন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় ঘটার সুযোগ হতে লাগল।

তবুও একটা নিরাপত্তাহীনতা আমাকে তাড়া করে বেড়াত। প্রণবদা রাজ্যে রুচি নিতে রাজি নন, বরকতদা আমাকে স্থান দিতে রাজি নম, আর দুঃসময়ে যে টিম গড়ে ঊঠেছিল, সেটাও দেখলাম আর অটুট নেই। যে যার নিজের মতো করে বাঁচতে চাইছে ।

গুলাম নবি চিঠিপত্র লেখালেখিতে আমার উপর বেশি ভরসা করত। আর আমি সময়ও দিতাম। তাই অনেক সময় একান্তে কথা বলারও সুযোগ হত। একদিন তাই বললাম, দেখো, তোমার সবচেয়ে বড় অ্যাডভান্টেজ হল তোমাকে ইন্দিরাজি সরাসরি চেনেন, আর আমাদের ভাগ্যের সুতো তো রাজ্যের নেতাদের হাতে বাঁধা। ওঁরা চাইলে মনোনয়ন পাওয়া যাবে, নইলে নয়। তাই মাঝে মাঝে হতাশায় ভুগি। ও বলল, কেন, তোমাকে ইন্দিরাজি চেনেন না? আমি বললাম, আমার তো তাই ধারণা। ও তখন আর কিছু বলল না।

পরদিন দুপুরবেলা ও বের হচ্ছে। আমাকে ডেকে বলল, ‘ডি পি’জি আইয়ে।’ আমি বললাম, ‘কোথায় ?’ ও বলল, ‘চলিয়ে না।’ আর কথা না বাড়িয়ে ওর গাড়িতে উঠে বসলাম।

গাড়ি সোজা ১, আকবর রোডে পৌছে গেল। ও ভেতরে যাচ্ছে। আমি রিসেপশনে বসে পড়লাম। ও বলল, ‘ইহা কিউ বৈঠতে হো? আও।’ আমি পেছন পেছন রওনা দিলাম। দেখলাম, সোজা ১, সফদরজং রোডে যাচ্ছে। অর্থাৎ ইন্দিরাজির রেসিডেন্সে। বাইরের ঘরে ধবন সাহেব ছিলেন। উনি গুলাম নবিকে বললেন, ‘যাইয়ে, ম্যাডাম, আপকা পুছ রহে থে।’ আমি তখনও দ্বিধায়। ধবনের ঘরে বসে রইলাম। গুলাম নবি হঠাৎ পিছন ফিরে আমাকে না দেখে আবার ফিরে এসে বলল, ‘আরে, তুম্‌ অন্দর কিউ নেহি আ রহে হো?’ আমি কুণ্ঠার সঙ্গে বললাম, আমি যাব? ও বলল, ‘তো লায়ে হ্যাঁয় কিস লিয়ে?’ আর দ্বিধা নয়। আমি ওর সঙ্গে ইন্দিরাজির বসার ঘরে পৌঁছে গেলাম। উনি এলেন। একটা সাদা কুর্তা ও মেখলা পরনে। একেবারেই ঘরোয়া পোশাকে। আলোচনা শুরু হল। ২৩ জুন থেকে পক্ষকালব্যাপী কর্মসূচি নেওয়া হবে ‘সঞ্জয় পাকখোয়ারা।’ অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল এটা বোঝানো যে সঞ্জয় গাঁধীর স্মৃতিকে কোনও পৃথক মঞ্চ বানিয়ে হাইজ্যাক করা যাবে না। ১৫ দিনের কর্মসূচি। কী কী করা হবে তাই নিয়ে আলোচনা। ধীরে ধীরে এককথায়-দু’কথায় আমিও আলোচনায় ঢুকে পড়লাম। ইন্দিরাজি সমান গুরুত্ব দিয়ে আমার কথাও শুনলেন। এবং একবারও মনে হল না, উনি আমাকে চেনেন না বা আমাকে কেন নিয়ে আসা হয়েছে, তা’ নিয়ে কোনও ভ্রুকুঞ্চনও দেখা গেল না। ঠিক হল, আমরা কেন্দ্রীয় স্তর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে পক্ষকালব্যাপী জেলায় জেলায় সভা করে সঞ্জয়জির স্বল্প জীবনে যে যে ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়েছিলেন তার প্রাসঙ্গিকতা দেশের যুবকর্মীদের ব্যাখ্যা করে বলব যাতে কাজের ভেতর সঞ্জয়জির লেগাসিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আমি পরে এই দায়িত্ব নিয়ে মহারাষ্ট্রের সবগুলো জেলায় পরিক্রমা করেছিলাম। সে অন্য গল্প।

যাই হোক, ইন্দিরাজির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গুলাম নবি বলল, ‘অব পতা চলা না, কি ম্যাডাম আপকো ভি জানতে হ্যাঁয়?’ আমি বললাম, হ্যাঁ, এরপর তো চেনে না বলবার কোনও সুযোগ নেই।

ইন্দিরাজী আজ নেই । তাই একসময়ের একটি জনপ্রিয় শ্লোগানের প্রাসঙ্গিকতা আজ হারিয়ে গেছে। আজ আর কারও নামে ধ্বনিত হয় না, ‘যুগ যুগ জিও’। যখন এ শ্লোগান উচ্চারিত হত তখনও জানতাম নশ্বর চেহারায় তিনি যুগ যুগ জীবিত থাকবেন না। তাঁর প্রদর্শিত পথ, তাঁর কীর্তি, সাফল্য দেশকে যুগ যুগ ধরে পথ দেখাবে এই বিশ্বাস আজও অন্তরে সজীব।

ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

Indira Gandhi's birth centenary Indira Gandhi Indian Female Prime Minister ইন্দিরা গাঁধী শতবর্ষে প্রিয়দর্শিনী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy