Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

খুনের সময় গাড়িতে ছিলেন, মানলেন সঞ্জীবই

হাল্কা হলুদ দামি সুতির জামা, বাদামি প্যান্ট ও পালিশ করা জুতো। কাঠগড়ায় উঠেই চোখে চশমাটা গলিয়ে নিলেন সঞ্জীব খন্না। নির্লিপ্ত মুখে সরকারি আইনজীবী ও নিজের আইনজীবীর সওয়াল শুনলেন। মাঝেমধ্যে মাথাটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বিচারকের কথাও শোনার চেষ্টা করলেন।

আলিপুর আদালতে সঞ্জীব খন্না। সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

আলিপুর আদালতে সঞ্জীব খন্না। সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫২
Share: Save:

হাল্কা হলুদ দামি সুতির জামা, বাদামি প্যান্ট ও পালিশ করা জুতো। কাঠগড়ায় উঠেই চোখে চশমাটা গলিয়ে নিলেন সঞ্জীব খন্না। নির্লিপ্ত মুখে সরকারি আইনজীবী ও নিজের আইনজীবীর সওয়াল শুনলেন। মাঝেমধ্যে মাথাটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বিচারকের কথাও শোনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নে তাঁর মুখ থেকে একটি শব্দও বেরলো না বৃহস্পতিবার।

শিনা বরা হত্যা মামলায় বুধবারই কলকাতায় এসে সঞ্জীবকে গ্রেফতার করেছে মুম্বই পুলিশ। প্রাক্তন টিভি ব্যারন পিটার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় এই মামলায় মূল অভিযুক্ত। মেয়ে শিনাকে বোন বলে পরিচয় দিয়ে যিনি মুম্বই নিয়ে গিয়েছিলেন। এবং ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল তিনিই ঠান্ডা মাথায় নিজের মেয়েকে খুন করেন বলে অভিযোগ। ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীবও ওই খুনে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। জেরায় ইন্দ্রাণী নিজে এবং তাঁর গাড়িচালক শ্যাম মনোহর রাই দু’জনেই সঞ্জীবের কথা বলেছেন বলে পুলিশের দাবি।

বুধবার আলিপুরের পেন রোডে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে সঞ্জীবকে গ্রেফতার করার পরে মুম্বই পুলিশ তাঁকে লম্বা জেরা করেছে। পুলিশ সূত্রের খবর, সঞ্জীব জানিয়েছেন, শিনাকে শ্বাসরোধ করে মারার পর মৃতদেহটি একটি ট্র্যাভেলার্স ব্যাগে ভরে গাড়ির পিছনের ডিকিতে রাখা হয়েছিল। তার পর একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সঞ্জীব দাবি করেছেন, ২৪ এপ্রিল তিনি তাঁর মেয়ে বিধির সঙ্গে দেখা করার জন্য মুম্বই পৌঁছন। সেখানে গিয়ে তিনি ইন্দ্রাণীকে ফোন করেছিলেন। প্রায় রাত আটটা নাগাদ ইন্দ্রাণী গাড়ি নিয়ে আসেন। তাঁকে গাড়িতে তুলে নেন। তিনি সামনের সিটে বসে ছিলেন। সঞ্জীবের দাবি, তিনি একাধিক বার ইন্দ্রাণীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সদুত্তর পাননি। সঞ্জীবের দাবি, গাড়িতেই তাঁর ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল। ঘুম ভাঙার পর তিনি দেখেন, একটি ট্র্যাভেলার্স ব্যাগের মধ্যে শিনার নিথর দেহ রয়েছে। কিছু ক্ষণ পর ওই ব্যাগটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ইন্দ্রাণীর নির্দেশে গাড়ির চালক শ্যাম ব্যাগে আগুন দেন বলে সঞ্জীবের দাবি।

সঞ্জীব এমন একটি ঘটনার সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও পুলিশকে জানাননি কেন? তাঁর দাবি, ইন্দ্রাণীই তাঁকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। নিজের ভবিষ্যৎ এবং নিজের মেয়ে বিধির ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি মুখ বন্ধ রাখেন।

পিটার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইন্দ্রাণী-সঞ্জীবের মেয়ে বিধি।
তিনি পিটারের দত্তক কন্যাও।
ছবি পুরনো পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

যদিও ইন্দ্রাণী এবং শ্যামের বয়ানের সঙ্গে সঞ্জীবের বয়ানের ফারাক রয়েছে। শ্যামের বয়ান অনুযায়ী, খুনের আগের দিন ২৩ এপ্রিল খার থানার গাগোট ভিলেজ নামে একটি নির্জন এলাকা তাঁরা দেখে এসেছিলেন। শিনাকে খুন করে কোথায় ফেলা হবে তা স্থির করার পরে কলকাতায় সঞ্জীবকে ফোন করে তাঁকে মুম্বইতে আসতে বলেন ইন্দ্রাণী। বান্দ্রা এলাকার হিলটপ হোটেলে একটি ঘরও বুক করা হয় সঞ্জীবের নামে। ২৪ এপ্রিল খুনের দিন, বিকেলে সঞ্জীব মুম্বই পৌঁছনোর পর ইন্দ্রাণী ও সঞ্জীব হোটেলের ওই ঘরে কিছু ক্ষণ সময় কাটান। সন্ধ্যার পর বান্দ্রার লিঙ্কিং রোড এলাকা থেকে শিনাকে গাড়িতে তোলা হয়। শিনা নিজেই মায়ের ফোন পেয়ে তাঁর ফ্ল্যাট থেকে নেমে এসেছিলেন, নাকি শিনার প্রেমিক রাহুল তাঁকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। আরও ধোঁয়াশা আছে, খুনের পরে কী হয় তা নিয়েও।

সে ব্যাপারে একটি বয়ান বলছে, শিনাকে শ্বাসরোধ মারা সময় পা চেপে ধরেছিলেন শ্যাম। হাত দু’টো ধরেন সঞ্জীব। শ্বাস রোধ করেন ইন্দ্রাণী। তার পর একটি পাথর দিয়ে শিনার মুখ থেঁতলে দেন শ্যাম। দেহটি ব্যাগে ভরে জ্বালিয়ে দিয়ে সে দিনই পুঁতে ফেলা হয় রায়গড়ের জঙ্গলে। আর একটি বয়ান বলছে, খুনটা করেছিলেন সঞ্জীবই। খুনের পর শিনার দেহ ব্যাগে ভরে গোটা একটা দিন গাড়ির ডিকিতে রাখা ছিল। গাড়ি ফিরে এসেছিল পিটার মুখোপাধ্যায়ের ওরলির বাড়ির গ্যারাজে। পরে ওই দেহ জঙ্গলে ফেলে আসা হয়। মোটের উপরে, ইন্দ্রাণীর দাবি, খুন তিনি করেননি। করেছেন শ্যাম এবং সঞ্জীব। শ্যামের দাবি, সঞ্জীব এবং ইন্দ্রাণীই খুনি। আর সঞ্জীব তো বলেইছেন, তিনি খুন করেননি। ঘুমোচ্ছিলেন।

সত্যিই কী ঘটেছিল, তা জানার জন্য সঞ্জীবকে আরও জেরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছে পুলিশ। এ দিন সঞ্জীবকে আলিপুর আদালতে তোলা হয়। সরকারি আইনজীবী সৌরীন ঘোষাল বলেন, ‘‘ধৃত চালক ও সঞ্জীবের বয়ানে মিল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সঞ্জীব এই খুনের ঘটনায় জড়িত বলেই প্রাথমিক ভাবে প্রমাণ হয়েছে।’’ পুলিশের কাছে সঞ্জীব যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, সেটি এ দিন আদালতে জমা দেওয়া হয়। তার পরই মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারক সঞ্জীবের জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে মুম্বই পুলিশের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আগামী ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সঞ্জীবকে মুম্বইয়ের বান্দ্রায় অতিরিক্ত মু্খ্য বিচারকের এজলাসে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ দিন রাতেই সঞ্জীবকে মুম্বই নিয়ে যাওয়া হয়।

তার আগে বুধবার রাতে আলিপুর থানার লকআপেই ছিলেন সঞ্জীব। রাতে সব্জি-ভাত খেয়েছিলেন। রাতেই সঞ্জীবের এক বান্ধবী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সঞ্জীবের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, এই বান্ধবীর (নাম প্রকাশ করা হল না) সঙ্গেই ইদানীং লিভ-ইন করতেন সঞ্জীব। নানা অনুষ্ঠানে, কার র‌্যালিতে তাঁদের একসঙ্গে দেখা যেত। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাওয়ালি রাজবাড়ি মেরামত করে দু’জনে একটি রিসর্ট বানাচ্ছিলেন। এ রাজ্যে তো বটেই, পড়শি রাজ্য ওড়িশাতেও একাধিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সঞ্জীব। তাঁর বন্ধুরা বলছেন, সঞ্জীব বরাবরই রঙিন মেজাজের মানুষ ছিলেন। তবে মানুষ খুন করতে পারেন, এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন বলে তাঁদের দাবি। তা হলে শিনা হত্যা মামলায় সঞ্জীব আদৌ জড়ালেন কী করে? পুলিশের কাছে সঞ্জীব নিজে জানিয়েছেন যে, বিচ্ছেদের পরেও ইন্দ্রাণীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি। তাঁর দাবি, ইন্দ্রাণী তাঁর কাছে ফেরত আসতে চাইছিলেন। মেয়ে বিধিকেও কাছে পেতে চাইছিলেন সঞ্জীব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE