রবীন্দ্রভবনে একটি অনুষ্ঠানে এমকে নারায়ণের সঙ্গে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়
সেন্ট্রাল উইং
রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরা এই উইং-এ থাকেন। এখানে মোট ৫টি স্যুইট। করিডরের পূর্ব দিকে মর্নিং রুম ও স্টাডি একসঙ্গে। মর্নিং রুমে রাষ্ট্রপতি অতিথি ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেন। পাশে জোড়া শোওয়ার ঘর, জোড়া স্নানঘর, ড্রেসিং রুম, বারান্দা। করিডরের পশ্চিমে সিনেমা হল, বিরাট ডাইনিং রুম, আর চারটি স্যুইট। চার নম্বর স্যুইটে ছিলেন ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। এই উইং-এর সব পর্দার রঙই হলদে ঘেঁষা। ঘটনাচক্রে ফার্স্ট লেডির প্রিয় রং হলুদ। তাঁর শোওয়ার ঘরটি ছিমছাম। দেওয়ালে অনেক ছবি। অমৃতা শের গিলের ‘ক্যামেলস’, যামিনী রায়ের ‘রথ’, গণেশ পাইনের ‘বীর বাহাদুর’। এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ‘হেড স্টাডি’। তিনি ছবিটি দেখে উচ্ছ্বসিত। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “ছবিটি হয়তো আসল নয়। তবুও...রবীন্দ্রনাথের নামটা জড়িয়ে আছে তো”। রবীন্দ্র অনুরাগিণী শুভ্রাদেবী। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকাও। তবে ফার্স্ট লেডি হওয়ার পর থেকে প্রোটোকল মেনে তাঁর অনুষ্ঠান করা বন্ধ।
এডিসি উইং
এই উইং-এ থাকেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সফররত সেনাবাহিনীর অফিসাররা (এডিসি)। করিডরে বেইজ রঙের উপর ফ্লোরাল ডিজাইনের গালিচা, সিল্কের পর্দা, গদি আঁটা চোয়ার, দেওয়ালে নৃত্যরত গণপতির ছবি, ললিত কলা অকাদেমির হাতি, বিশ্বব্রহ্মা মন্দির। চিনেমাটির সাদা টবে প্ল্যান্ট।
ইতিহাসের পাতায় নিলয়ম
ভবনের মতো নিলয়মের পরতে পরতেও জড়িয়ে আছে ইতিহাস। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে সাবসিডিয়ারি অ্যালাইয়েন্সে চুক্তিবদ্ধ নিজাম বোলারামের জমি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। ১৮৬০ সালে তৈরি হয় এই বাংলো বাড়ি। হায়দরাবাদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় প্রসিদ্ধ রাজেন্দ্র প্রসাদের কথায়, “দ্বিতীয় নিজাম জমিটি ব্রিটিশদের দিয়েছিলেন। নিলয়ম আদতে আর্মি হাউস। প্রধান সেনা অফিসারের আবাসন ছিল এই বাড়িটি। স্যর উইনস্টন চার্চিলও (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) এখানে এসে থেকে গিয়েছেন।’’ প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতির হায়দরাবাদ সফরকালে সেনাপ্রধান জয়ন্ত চৌধুরীর কথা প্রবীণ হায়দরাবাদিদের মনে পড়ে যায়। ১৯৫০ সালে যিনি ভারতের সঙ্গে হায়দরাবাদ সংযুক্তিকরণের মূল হোতা ছিলেন। এই নিলয়মের দখল নেন তিনিই।
মিলেমিশে একাকার ইতিহাস-বর্তমান
গোধূলির আলো মাখা আকাশকে পিছনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিলয়ম। জ্বলে উঠেছে বাগানের সব সোলার বাতি। সবুজ অন্ধকার ক্রমশ গ্রাস করছে গোটা এলাকা। নিলয়মের বাগানের সেই বিরাট গাছটাও একটু পরে অন্ধকার হয়ে যাবে। সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠে যে গাছটিকে দেখে রাষ্ট্রপতির মনে পড়ে যায় পল্টুকে (প্রণববাবুর ডাক নাম)। যে পল্টু বাল্যকালে এই রকমই এক বকুল গাছের কোটরে বইপত্তর লুকিয়ে রেখে খেলতে যেতেন! গাড়ির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিলয়ম ক্রমশ অপস্রিয়মাণ। প্রেক্ষাপটে নিজাম আসফ জাহ, জয়ন্ত চৌধুরী, প্রণববাবু, শুভ্রাদেবী, পল্টু....সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
অন্য এক ‘মুঘল গার্ডেন্স’
রুদ্রাক্ষ, রোজমেরি, তুলসী, লবঙ্গ তুলসী, সর্পগন্ধা, সমুদ্রপালা, চন্দন, লেমন গ্রাস, কালমেঘ, ইসবগুল, আদা, নীলি, সরস্বতী আকু, ভামু আকু...জানা-অজানা মিলিয়ে মোট ১১৬ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে নিলয়মের পিছন দিকে বিশাল ভেষজ উদ্যান। এই উদ্যান নিলয়মের ‘মুঘল গার্ডেন্স’। সর্দিকাশির মতো সাধারণ রোগ থেকে শুরু করে চুল পড়া, খুসকি, দাঁদ, অম্বল, ঘা, রক্তাল্পতা, স্নায়ু-যকৃৎ-কিডনির সমস্যা, হাঁপানি, কুষ্ঠ, এমনকী স্ট্রেস সংক্রান্ত সমস্যা, স্মৃতিভ্রংশ...এই উদ্যানে কোন রোগের ভেষজ-সমাধান নেই! পূর্বতন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা দেবী সিংহ পাটিল এই উদ্যানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দু’বছর আগে বড়দিনে। লতানো গুল্ম-গাছপালা-ঝোপঝাড় বেড়ে উঠে সৃষ্টি করেছে অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ।
সবুজে-সবুজ নিলয়মের বিশাল চত্বর। ময়দানের মতো সবুজ ঘাসে ছাওয়া লন। ৩৫ একর জমির উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সাড়ে চার হাজার গাছ। বট-অশ্বত্থের পাশাপাশি আম-পেয়ারা-আমলা-নারকেল-বেদানা-সফেদা-লিচু...বকুল, হাস্নাহানা, গাঁদা, হরেক রঙের গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, জবা...এমনকী তুলসীমঞ্চও। একেবারে যেন বর্ধিষ্ণু সুখী এক গৃহের ছবি!
(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২ জানুয়ারি ২০১৩, আনন্দবাজার পত্রিকায়)