Advertisement
E-Paper

মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৪৫, ট্রেন বেলাইন কেন, বলে দেবে ১৩টি টুকরো

রেল লাইনের ১৩টি ভাঙা টুকরো। পুখরায়াঁর ধংসস্তূপ থেকে তোলা এই টুকরোগুলোর মধ্যেই গতকালের ট্রেন দুর্ঘটনার যাবতীয় রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৩
রেল লাইনের সেই ভাঙা অংশ। —নিজস্ব চিত্র

রেল লাইনের সেই ভাঙা অংশ। —নিজস্ব চিত্র

রেল লাইনের ১৩টি ভাঙা টুকরো। পুখরায়াঁর ধংসস্তূপ থেকে তোলা এই টুকরোগুলোর মধ্যেই গতকালের ট্রেন দুর্ঘটনার যাবতীয় রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

দুর্ঘটনার অভিঘাতে লাইন যেখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকেই এই টুকরোগুলো সংগ্রহ করেছে তদন্তের দায়িত্বে থাকা সুরক্ষা কমিশনারের দলবল। তাদের দাবি, ওই সব টুকরো পরীক্ষা করেই বোঝা যাবে, লাইনে চিড় থাকার জন্যই দুর্ঘটনা কি না। সরকারি ভাবে সুরক্ষা কমিশনারের দলের সদস্যরা মুখ না খুললেও, ভাঙা লাইনগুলো দেখে তাঁরা এক প্রকার নিশ্চিত যে, রেল লাইনে চিড় থাকার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

কী ভাবে? ভাঙা টুকরোগুলো দেখে মনে হচ্ছে, তাদের যেন মাঝখান থেকে আড়াআড়ি ভাবে চেঁছে ফেলা হয়েছে। লাইনের মসৃণ অংশটির ওপরে ট্রেনের চাকা থাকে এবং লাইনের নীচের অংশটি মাটিতে গাঁথা থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এই দু’টি অংশ একেবারে মাঝখান থেকে ভেঙে গিয়েছে। তদন্তকারীদের পর্যবেক্ষণ, ভাঙা অংশগুলোয় মরচে ধরেছে। যা একেবারেই অনভিপ্রেত।

তদন্তকারীদের মতে, লাইনে খারাপ মানের ইস্পাত ব্যবহার করা হলে তাতে চিড় ধরতে পারে। আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওই ফাটল ধরা পড়ে না। এই জোড়া গাফিলতিতেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। এ ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের অনুমান। ইস্পাত তৈরির সময় ভিতরে অনেক সময় বাতাসের বুদবুদ থেকে যায়। চিড় ধরার আশঙ্কা তৈরি হয় সেখান থেকেই। কোথাও চিড় আছে কি না, অথবা চিড় ধরার আশঙ্কা রয়েছে কি না, তা ধরার জন্য রেলের হাতে ‘আলট্রাসনিক ফ্ল ডিটেক্টর’ মেশিন রয়েছে। ওই যন্ত্রটি হাতে ধরে লাইনের ওপর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যান কর্মীরা। তখন মেশিনের গ্রাফ পেপারে ফুটে ওঠে লাইনের কোথায় গোলামাল রয়েছে। এই ডিভিশনে ওই পরীক্ষা সময় মতো করা হয়েছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখবেন তদন্তকারীরা।

তদন্তকারীদের বক্তব্য, শীত পড়তেই লাইনের সঙ্কোচন ও প্রসারণ ওই চিড়কে সম্ভবত আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেসের তিনটি কামরা যাওয়ার পরেই আর চাপ সহ্য করতে না পেরে সম্ভবত মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে যায় ওই লাইনটি। ফলে প্রবল গতিতে থাকা পরের কামরাগুলো একে অন্যের ঘাড়ে ধাক্কা মেরে বেলাইন হয়ে যায়।

তা হলে এই দুর্ঘটনার দায়িত্ব কার?

রেলকর্তাদের একাংশ বলছেন, রেল মন্ত্রক সংশ্লিষ্ট জোনের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে বলবে, সেই জোনের গাংম্যানেরা সময় মতো নজরদারি না চালানোয় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যাঁরা লাইনে নেমে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন সেই গ্যাংম্যান, ট্র্যাকম্যান বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের পদ ক্রমশই উঠিয়ে দিচ্ছে রেল। রেল সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেলমন্ত্রিত্বের সময় থেকে সুরেশ প্রভুর জমানা পর্যন্ত এক লক্ষেরও বেশি চতুর্থ শ্রেণির পদ খালি রয়ে গিয়েছে। এই সব কর্মীর কাজই হলো, পায়ে হেঁটে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত লাইন পরীক্ষা করা। ফলে সবাই এখন বলতে শুরু করেছে, রেলের নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা ওই পদগুলো উঠিয়ে দেওয়ায় রেলের নিরাপত্তাও কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক!

রেলের কর্মচারী ইউনিয়ন, ‘অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে ম্যানস ফেডারেশন’-এর সভাপতি শিবগোপাল মিশ্রের মতে, “এই সব কর্মী এতটাও অভিজ্ঞ হন যে, লাইনে ধাতব দণ্ড দিয়ে আওয়াজ করে বুঝে যান তা ঠিক আছে কি না। কিন্তু নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ থাকায় এখন একজন গ্যাংম্যানকেই দু’-তিন জনের কাজ করতে হচ্ছে। ফলে কাজের ক্ষেত্রে ত্রুটি থেকে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকছে।”

আজ সংসদে রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু আশ্বাস দিয়েছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না হয় তার দিকে নজর দেওয়া হবে। তিনি জানান, তদন্তে যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে।

এর মধ্যে সোমবারই বিকেলে পুখরায়াঁতে উদ্ধারকাজ অভিযান শেষ বলে জানিয়ে দিয়েছে রেল ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। এখন পর্যন্ত সরকারি ভাবে মৃতের সংখ্যা ১৪৫। গতকাল গোটা রাত ধরে উদ্ধারকাজ চালালেও কোনও যাত্রীকেই জীবিত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সোমবার সকাল থেকেই গোটা এলাকায় পচা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় সন্দেহ হয়েছিল, ধ্বংসস্তূপের নীচে এখনও মৃতদেহ আটকে থাকতে পারে। নিয়ে আসা হয় স্নিফার ডগ। তাদের সাহায্যেই এ দিন উদ্ধার হয় আরও কয়েকটি দেহ।

সহ প্রতিবেদন: অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

ভ্রম সংশোধন

সোমবার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘লাইনের ফাটলই কি ডেকে আনল বিপর্যয়’ শীর্ষক খবরে লেখা হয়েছে, ‘‘আর ঘণ্টা দেড়েক পরেই পটনা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল ট্রেনটির।’’ আসলে ট্রেনটির ভোর ৪.৪০ নয়, বিকেল ৪.৪০-এ পটনা পৌঁছনোর কথা ছিল। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

Investigation derail
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy