রেমা রাজেশ্বরী
মার্চের তেতেপোড়া গরম। তেলঙ্গানার জগুলাম্বা গারোয়াল গ্রামে পুলিশের চোখে অদ্ভুত ঠেকেছিল ব্যাপারটা। এই সময়ে গ্রামের লোকজনের বাইরে ঘুমোনোটাই অভ্যেস। কিন্তু ঘরের দরজা-জানলা এঁটে ভিতরে সবাই। হচ্ছেটা কী?
গ্রামের স্থানীয় পুলিশের মুখে ঘটনাটা শুনেই বিশদে খোঁজ নিতে পাঠান রেমা রাজেশ্বরী। তেলঙ্গানার গ্রামের এই এসপি বরাবরই অন্য ধাতের। সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক তৈরিতে সক্রিয়। বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, শিশুদের উপরে যৌন নিগ্রহ— এই সব নিয়ে সচেতনতা প্রচার চালিয়েছেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
২০ জন কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন গ্রামের সব দিকে। কনস্টেবল-দল ফিরে এসে রেমাকে জানান, গোটা গ্রামের লোক ভয়ে কাঁপছে। হোয়াটসঅ্যাপে বিশেষ কিছু ভিডিয়ো আর ছবি পেয়ে তাঁদের ওই দশা। ভিডিয়ো-ছবিতে ‘অচেনা’ লোক সম্পর্কে সাবধান করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামে। চিন্তায় পড়ে যান রেমা। কারণ জাল ভিডিয়ো ছড়িয়েই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছিল।
রেমার কথায়, ‘‘তখনও কোথাও গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর শিরোনামে আসেনি। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকেই আমরা গ্রামে এক প্রস্ত প্রচার শুরু করেছিলাম।’’ জগুলাম্বা গারোয়ালে গুজব রুখতে নিজের কনস্টেবল-দলের সঙ্গে বসতে দেরি করেননি এই এসপি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ভুল বার্তা বা ছবি, কী ভাবে চেনানো যায়, তা নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি। নিজে যথেষ্ট টেক-স্যাভি। আইপিএস হওয়ার আগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কম্পিউটার সায়েন্সে। টুইটারে তাঁর ফলোয়ার ২৯ হাজার।
ই-মেলে রেমা জানালেন, প্রথমে দরজায় দরজায় ঘুরে জাল ভিডিয়ো চেনার উপায় বাতলেছেন তাঁরা। গ্রামবাসীদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপে কিছু পেলেই পাগলের মতো ফরোয়ার্ড করতে শুরু করবেন না। যা পাচ্ছেন, তা-ই বিশ্বাস করবেন না।’
দ্বিতীয় দফায় ঢ্যারা পিটিয়ে পুলিশের তরফে বার্তা দেওয়া শুরু হয়। রেমা বললেন, ‘‘স্থানীয় ভাবে এদের বলে ‘দাপ্পু’ শিল্পী। এক মিনিটে ওঁদের বার্তা দিতে বলা হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন পুলিশ অফিসাররাও। ঢ্যারা পিটিয়ে ওঁরা লোকজন জড়ো করতেন।’’ এর পরে রেমা নিজে গিয়ে গ্রামের সরপঞ্চ, উপ-সরপঞ্চদের
সঙ্গে দেখা করেন। জগুলাম্বা গারোয়ালে ১৯৪ জন সরপঞ্চ। সঙ্গে ওয়ানাপার্থি জেলার ২৩৩ জন। (ওয়ানাপার্থির অতিরিক্ত দায়িত্ব রয়েছে রেমার কাঁধে)।
একেবারে তৃতীয় দফায় স্থানীয় লোকশিল্পীদের দিয়ে গান বাঁধিয়ে প্রচার শুরু করে রেমার নেতৃত্বাধীন দল। স্থানীয় সংস্কৃতির উপরে নির্ভর করে গানের কলি ছুঁয়ে যায় সাধারণ মানুষকে। রেমার দাবি, ‘‘এটা খুব কাজে দিয়েছিল।’’
মার্চের মাঝামাঝিই জগুলাম্বা গারোয়ালে দায়িত্ব নিয়েছিলেন রেমা। নতুন এলাকা হলেও ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। বিশেষ করে এই গ্রামটি আবার সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় উদ্বেগ ছিল আরও বেশি। তাই অনেক জায়গা থেকে গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর এলেও রেমার ‘দাওয়াই’ কাজ দিয়েছিল এখানে। গুজব ছড়ালেও তেলঙ্গানার ওই সব গ্রাম ছিল পুরোপুরি নিরাপদ।
সাত মাস পেরিয়ে গিয়েছে। গণপিটুনির খবর এখন আর সে ভাবে শোনা যাচ্ছে না। কী অবস্থা সেই গ্রামগুলোর? রেমা এখন মেহবুবনগর জেলার এসপি। জানালেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো ভুয়ো খবর চেনাতে এবং ঠেকাতে এখনও ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর দল। ‘‘এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ার গুজব থেকে হিংসা ছড়ানোর মতো পরিস্থিতি হয়তো নেই। কিন্তু আমরা সব সময়ে সজাগ। কারণ এই জেলাগুলো সাম্প্রদায়িক ভাবেও কিছুটা সংবেদনশীল। আমার সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারি গোষ্ঠীও চোখকান খোলা রাখছে।’’
রেমার বক্তব্য, ‘‘ভারতে অনেক রকম কুসংস্কার দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেগুলোর অপব্যবহার বেড়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, যাঁরা গণপিটুনির শিকার, তাঁরা হয় প্রান্তিক সম্প্রদায়ের, অথবা অল্প রোজগার করেন, না হলে শরণার্থী কিংবা ভবঘুরে।’’ হায়দরাবাদে এক রূপান্তরকামীকে পেটানোর খবরও এসেছে বলে জানান তিনি। এ সব থেকে তাঁর মনে হয়েছে, ‘‘বিশ্বাসের উপরে যুক্তি খুব কম সময়েই জিতছে। তাই ভুয়ো খবর চিনিয়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না।’’
সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগিয়ে চলেছেন রেমা রাজেশ্বরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy