জলমগ্ন এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্যে। বুধবার শ্রীনগরের রাস্তায়। ছবি: এএফপি।
আবহাওয়া পরিষ্কার। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের নানা জায়গায় শুরু হয়েছে ত্রাণ সঙ্কট। প্রায় আশি হাজার জন উদ্ধার হলেও লক্ষাধিক মানুষ এখনও আটকে অনেক জায়গায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বহু বাঙালি পর্যটকও। খাবার ও পানীয় জলের অভাবে পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হচ্ছে সে সব জায়গায়। অভিযোগ, তাঁদের উদ্ধারে তেমন তত্পর নয় প্রশাসন। ত্রাণও এসে পৌঁছচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার প্রতি বিক্ষোভ দেখা গেলেও সেনার উপরেই ভরসা রাখছেন সকলে।
আজ সকাল থেকে কিছু অঞ্চলে আংশিক ভাবে সচল হয়েছে বিএসএনএলের টেলি যোগাযোগ পরিষেবা। কলকাতার কেষ্টপুরের বাসিন্দা নম্রতা চক্রবর্তী টেলিফোনে জানালেন, পরিবারের সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। শ্রীনগরের একটি হোটেলে গিয়ে ওঠেন শুক্রবার। কিন্তু ক্রমাগত বৃষ্টিতে সে দিন থেকেই হোটেলে আটকে পড়েন তাঁরা। শনিবার রাতের পর থেকে কাজ করছিল না ফোন। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
বৃষ্টি এক বারও থামেনি। হু হু করে বাড়ছিল জলস্তর। একটা সময়ের পর বিপদ বুঝে আরও শ’খানেক মানুষের সঙ্গে শ্রীনগরের হরি পর্বতের উপর সারিকা দেবী মন্দিরে উঠে যান নম্রতারা। পাঁচ দিন টানা বৃষ্টির পর গত কাল বৃষ্টি থামায় একটু হলেও স্বস্তি মিলেছে। প্রায় ১০০ জনের মতো রয়েছেন ওই মন্দিরে। বেশির ভাগই জম্মুর বাসিন্দা। কিছু কাশ্মীরি পণ্ডিতও আছেন। কিন্তু ৬ মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৮৪ বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলেই দেশ-কাল-ভাষা-ধর্মের দূরত্ব পার করে ফেলেছেন। বিপদের কোনও ভেদাভেদ হয় না যে!
নম্রতা জানালেন, খাবার প্রায় শেষ। ফুরিয়ে আসছে পানীয় জলও। কিন্তু এখনও কোনও সাহায্য এসে পৌঁছয়নি। বেশির ভাগ মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ছোট বাচ্চারা খিদেয় কাঁদছে। বড়রা অসহায়। ঠান্ডায় কুঁকড়ে রয়েছেন সবাই। সেনার কিছু লোক এসে পৌঁছেছেন ঠিকই, কিন্তু আটকে পড়াদের বার করে নিয়ে যেতে পারছেন না। হরি পর্বতের উপর একটা হেলিপ্যাডও আছে বলে জানান নম্রতা। কয়েক দফায় কিছু মানুষকে নিয়েও যাওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, স্থানীয়দেরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। নম্রতা জানালেন, সেনাবাহিনীর লোকেরা বলছে ধৈর্য ধরতে। আরও খারাপ অবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আগে উদ্ধার করছে কপ্টার।
নম্রতা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেও, অনেকেই এখনও কোনও খবর পাননি পরিচিতদের। পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিতে পহেলগামের একটি ইনস্টিটিউটে গিয়েছেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা নিহাল সরকার। ১৯ বছরের নিহালের পরিবার জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের এক তারিখ থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। নিহাল বৃহস্পতিবার ফোনে জানিয়েছিলেন, “খুব বৃষ্টি পড়ছে, ট্রেক শুরু করতে পারিনি আমরা।” বৃহস্পতিবার দুপুরেও ফোনে জানায়, লে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ধস নেমে রাস্তা বন্ধ। ব্যাস। তার পর থেকে আর কোনও যোগাযোগ নেই বলে জানাল নিহালের পরিবার।
আজকেই কোচি পৌঁছেছেন বন্যায় আটকে পড়া মালয়ালি অভিনেত্রী অপূর্বা বোস। জানিয়েছেন, ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তিন দিন প্রায় অনাহারে ছিলেন। জলও প্রায় ছিল না। গত কাল সেনাকপ্টার এসে উদ্ধার করে তাঁকে। উদ্ধারকর্মীরা শিশু ও মহিলাদের আগে উদ্ধার করেছেন। তাঁর দলের আরও ১০ জন এখনও আটকে রয়েছেন।
আজ অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছতে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়ছেন উদ্ধারকর্মীরা। শ্রীনগরে সেনার গাড়ি লক্ষ্য করে পাথরও ছোড়েন কিছু মানুষ। রাজ্যপালের বাসভবনের কাছে চারটি কপ্টার নামতেই পারেনি ক্ষুব্ধ জনতার ভিড়ে। কাশ্মীরের ত্রাণ শিবির পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়েন কংগ্রেস নেতা সৈফুদ্দিন সোজ। সরকারি কর্মচারীদের বহু পরিবার বিক্ষোভ দেখান জম্মুতে। প্রতিবাদ চলেছে শ্রীনগর বিমানবন্দরের বাইরেও। সকলেরই দাবি, অনেক জায়গায় বহু দুর্গত আটকে রয়েছেন অনাহারে। ত্রাণ পৌঁছচ্ছে না।
সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ আজ বন্যাবিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে বলেন, “সাধারণের ক্ষোভ সঙ্গত। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ নয়। কিন্তু দিন-রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। যেখানে বেশি প্রয়োজন, সেখানেই আগে ত্রাণ পৌঁছনোর চেষ্টা চলছে।” তিনি জানান, আট হাজার কম্বল, সাড়ে ছ’শো তাঁবু, দু’লক্ষ লিটার পানীয় জল, আড়াই হাজার কিলো বিস্কুট, সাত হাজার কিলো শিশুখাদ্য বণ্টন করা হয়েছে দুর্গতদের মধ্যে। দলবীর আশ্বাস দেন, দু-তিন দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কাশ্মীরের একাধিক সেনাছাউনিতে হাজার খানেক সেনা পরিবার আটকে রয়েছে বলেও জানান তিনি। এ-ও জানান, অনেক দুর্গম জায়গায় উদ্ধারকাজে গিয়ে বিপদে পড়ছেন সেনারাই। পথ দেখাতে তাই সাহায্য করছেন স্থানীয়রাও।
উদ্ধারকাজে কোনও ফাঁকি নেই জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা আজ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “সেনার চেষ্টায় আংশিক সক্রিয় হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। নৌকা এবং কপ্টার পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে প্রতিটি বন্যাকবলিত এলাকায়। যেখানে যেখানে সম্ভব হচ্ছে না, পাঠানো হচ্ছে ত্রাণ।” দুর্গতদের একাংশের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আসার আগে পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ করেনি রাজ্য। ওমর অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, “১০০ বছরের মধ্যে প্রথম এমন পরিস্থিতি হল এখানে। তার জন্য তো আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যখন এসে পৌঁছেছেন, তখন দুর্যোগের প্রাথমিক ধাক্কা অনেকটাই সামলে উঠেছিলাম। পুরোদমে উদ্ধারকাজ শুরু করে দিয়েছিলেন কয়েক হাজার সেনা।”
এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রের খবর, তাদের একটি বিমান বন্যাদুর্গতদের জন্য কাজ করছে। দিল্লি থেকে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছনো হচ্ছে কাশ্মীরে। সেখানকার শিবির থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষদের দিল্লি ফিরিয়েও আনছে বিমানটি। বিনামূল্যে। এই কাজের জন্য মজুত আছে আরও একটি বিমান। উদ্ধারকাজে সহায়তা করছে আইআরসিটিসি-ও।
অন্য দিকে, গত ক’দিনের ভারী বর্ষণে আংশিক বিপর্যস্ত অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত এবং হিমাচলপ্রদেশও। ৩৬ ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মধ্য এবং উত্তর গুজরাতে। এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে বডোদরা-সংলগ্ন এলাকার বিশ্বামিত্র এবং মাহিসাগর নদীর জল। শহরের পাশাপাশি ভেসে গিয়েছে গ্রামাঞ্চলেরও একটা বড় অংশ। বন্যা পরিস্থিতির শিকার অন্তত ২ লক্ষ মানুষ।
দমকল এবং জাতীয় বিপর্যয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহায্যে মঙ্গলবার সন্ধের মধ্যেই ১,৮০০ জনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি গুজরাত সরকারের। বুধবার নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও ২০০ জনকে। চরম সতর্কতা জারি করা হয়েছে সরকারি তরফে। ত্রাণের কাজে সেনাবাহিনীর সাহায্যও চাওয়া হয়েছে বুধবার। পরিস্থিতির কারণে আপাতত বডোদরার স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। বন্ধ রাখা হয়েছে বিশ্বামিত্র নদীর উপর তিনটি সেতুও। এখনও জলমগ্ন এলাকার বহু আবাসন, রাস্তাঘাট। মঙ্গলবারই জল ঢুকে যায় শহরের একটি হাসপাতালে।
জল পেরিয়ে ভূমিষ্ঠ নবজাতক
উদ্ধারকর্মীদের তত্পরতায় উদ্ধার হলেন অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলা। তার পরেই হাসপাতালে সুস্থ পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। সেনা সূত্রের খবর, বুধবার শ্রীনগরের পামপোর এলাকা থেকে একটি জরুরি বার্তা পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন তাঁরা। জলমগ্ন বাড়ি থেকে প্রথমে নৌকায় করে আর্শিদাকে বার করে আনা হয়। তার পরে কপ্টারে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা হাসপাতালে। মা-ছেলে দু’জনেই সুস্থ আছে বলে জানিয়েছেন চিকিত্সকেরা।