দিল্লির একটি হাসপাতালে অরবিন্দ কেজরীবাল। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
এ বার মারা গেল ছ’বছরের একটি শিশু। এবং ৩০ বছরের এক মহিলা। এ পর্যন্ত দিল্লিতে ডেঙ্গির বলি ১১ জন। আজই গাজিয়াবাদে এই রোগে মৃত্যু হয়েছে ৪৫ বছর বয়সি এক মহিলা কনস্টেবলের। এই জেলায় আক্রান্ত ৬০ জন। দিল্লিতে সংখ্যাটা শনিবার পর্যন্ত ছিল ১,৮৭২। সন্দেহ নেই, এ ক’দিনে তা দু’হাজার ছুঁতে চলেছে। কিন্তু আসল রোগটা কি ডেঙ্গি? এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীতে।
চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন রোগটা ডেঙ্গিই। পাঁচ বছরের ব্যবধানে যা ফের মারাত্মক আকার নিয়েছে দিল্লি ও তার আশপাশে। এবং তার চেয়েও যেটা উদ্বেগের, তা হল ডেঙ্গির জীবাণুর সবচেয়ে রমরমা হয় অক্টোবরে। আর এটা সবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। ফলে আগামী দিনগুলিতে রোগটা আরও মারাত্মক আকার নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
দিল্লিবাসী কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন আসল রোগটা তার চেয়েও ঢের বেশি ভয়ঙ্কর! এবং রোগটা রাজধানীর চিকিৎসা ব্যবস্থার গভীরে। রোগটির নাম কেউ বলছেন, অর্থলোভ। আম দিল্লিবাসীর আর একটি অংশ বলছে, নিজেদের দায়িত্ব পালনে প্রশাসনের গাফিলতি ও উদাসীনতাও এই পরিস্থিতির জন্য সমান দায়ী। নইলে বেসরকারি হাসপাতালে গরিবদের চিকিৎসার জন্য যে সব ফ্রি বেড থাকার কথা, সেগুলিই মওকা বুঝে পেয়িং বেড করে দেওয়া হবে কেন? কেনই বা এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালের দোরে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে শিশুরা?
পাঁচ-পাঁচটি হাসপাতাল ফিরিয়ে দেওয়ার পরে সাত বছরের অবিনাশ রাউত মারা গিয়েছে গত মঙ্গলবার। অভিযোগ, স্রেফ বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে সে। অবিনাশ সুস্থ আছে বলে তাকে ভর্তি নিতে অস্বীকার করেছিল পাঁচটি হাসপাতাল। ষষ্ঠ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই নেতিয়ে পড়ে অবিনাশ। ছেলেকে ন্যূনতম চিকিৎসা দিতে না পারার যন্ত্রণায় চার তলার আবাসন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন অবিনাশের বাবা-মা। ঘটনটির বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে কেজরীবাল সরকার গোটা পর্বটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেও, দিল্লির চিকিৎসা পরিষেবার বেহাল ছবিটা ফের সামনে চলে আসে আমনের মৃত্যুতে। দক্ষিণ দিল্লির শ্রীনিবাসপুরীর বাসিন্দা ৬ বছরের আমনকে সফদরজঙ্গ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন, সে সুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি করার কোনও প্রয়োজন নেই। দু’দিন পরে আমনের শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায় আমনের পরিবার। সেখানে উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় ফের সেই রাতে সফদরজঙ্গ হাসপাতালে নিয়ে যান আমনের পিতা মনোজ শর্মা। মনোজের অভিযোগ, রাতভর ছেলেকে দেখার জন্য কোনও চিকিৎসক আসেননি। বাধ্য হয়ে ফের স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যান ছেলেকে। সেখানেই সে মারা যায়।
এ ভাবে দু’টি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হইচই শুরু হওয়ায় অবশেষে নড়েচড়ে বসে দিল্লি সরকার। অবিনাশের মৃত্যুর সাত দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল আজ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে দেখে তোপ দেগেছেন, দরকারে সাময়িক ভাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলি ‘টেক ওভার’ করে নেবে তাঁর সরকার।
অধিগ্রহণের এমন কোনও আইন আছে কি? নেই। তাতে কী! অরবিন্দের দাওয়াই, বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে নয়া আইন বানাবে তাঁর সরকার। অরবিন্দ বলছেন, বেড বাড়ান। ডেঙ্গির রোগী ফেরাবেন না। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গরিবগুর্বোদের চিকিৎসার জন্য কিছু বেড নির্দিষ্ট রাখার শর্তেই ছাড়পত্র পায় বেসরকারি হাসপাতাল। সেই শর্ত যে মানা হচ্ছে না, সে খবরটা আম আদমি পার্টির শীর্ষ নেতার নজরে আসতে এতগুলি দিন লেগে গেল কেন?
আজ দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন ও আপের বিধায়করা বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পরে দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতালের পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন কেজরীবাল। ডেঙ্গি রোগীদের জন্য দিল্লিতে বাড়তি এক হাজার শয্যার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য দফতর। ছুটি বাতিল করা হয়েছে সমস্ত চিকিৎসক ও নার্সদের। চালু হয়েছে ফোনের হেল্পলাইন (১০৩১)। হাসপাতালগুলি কেন আমন ও অবিনাশের চিকিৎসা করায়নি তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে দিল্লি সরকার। দোষী প্রমাণিত হলে হাসপাতালগুলির লাইসেন্স বাতিল করা হবে জানিয়েছেন দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র। তিনি আজ ফোন করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডাকে বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ফেরালে আপনারা কড়া পদক্ষেপ করুন। সত্যেন্দ্র আজ দিল্লির সব বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের এক হাজারেরও বেশি প্রতিনিধিকে নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় নিয়ম শিথিল করে ডেঙ্গির চিকিৎসার জন্য বেডের সংখ্যা বাড়াতে বলেছেন তিনি। ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রেও কিছু নির্দেশ দিয়েছেন।
দিল্লির স্কুলপড়ুয়াদের আগামী দিনে ফুল হাতা শার্ট ও ফুলপ্যান্ট পরার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া। ফুল হাতা স্কুলের পোশাক না থাকলে অন্য রঙের জামাকাপড় পরে যাওয়া যাবে।
কেন্দ্রের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডিজি (স্বাস্থ্য পরিষেবা) জগদীশ প্রসাদের মতে, ‘‘আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি, একাধিক ডেঙ্গি ভাইরাসের উপস্থিতির ফলেই পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে পড়েছে।’’ দিল্লিতে পাঁচ বছর আগে যেখানে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১,৬৯৫, সেখানে এখনই তা দু’হাজার ছুঁইছুঁই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ব্যবস্থা না নিলে আগামী মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বাইলারি সায়েন্স প্রতিষ্ঠানের প্রফেসর একতা গুপ্তের মতে, ‘‘এই রোগের প্রাদুর্ভাব সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি হয়ে থাকে। আগামী দিনগুলিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে চলেছে।’’
আগামীর প্রশ্ন পরে, কেজরীবাল সরকার যে ডেঙ্গির প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাতেই ব্যর্থ, আপ শিবির ঘরোয়া আলোচনায় তা স্বীকার করছে। বিপক্ষ শিবিরকে আক্রমণের এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না কংগ্রেস। দিল্লির প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অজয় মাকেন এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার, দিল্লির কেজরীবাল সরকার ও রাজধানীর বিজেপি পরিচালিত পুরসভাগুলিকে। এ সপ্তাহের শেষ নাগাদ কংগ্রেস কেজরীবালের বাড়ির সমানে বিক্ষোভ দেখাবে বলেও ঘোষণা করেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy