Advertisement
E-Paper

লাদাখ থেকে অরুণাচল, সুদীর্ঘ চিন সীমান্তে দুর্ভেদ্য সমরসজ্জায় ভারত

সুদীর্ঘ চিন সীমান্তে রণনীতি অমূল বদলে ফেলছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী। কাশ্মীর তথা লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ— এতগুলি রাজ্যকে ছুঁয়ে রয়েছে চিনের সীমান্ত। এই লম্বা সীমান্তরেখায় এক সময় ভারতের নীতি ছিল শুধু আত্মরক্ষা। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সেনাকর্তারা এখন এক সুরে বলছেন, সেই যুগ অতীত।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৬ ১৭:১৫
দুর্গম লাদাখ আর অরুণাচলে যে ভাবে দ্রুত বাড়ছে ভারতের রণসজ্জা, তাতে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট বেজিং। —ফাইল চিত্র।

দুর্গম লাদাখ আর অরুণাচলে যে ভাবে দ্রুত বাড়ছে ভারতের রণসজ্জা, তাতে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট বেজিং। —ফাইল চিত্র।

সুদীর্ঘ চিন সীমান্তে রণনীতি অমূল বদলে ফেলছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী। কাশ্মীর তথা লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ— এতগুলি রাজ্যকে ছুঁয়ে রয়েছে চিনের সীমান্ত। এই লম্বা সীমান্তরেখায় এক সময় ভারতের নীতি ছিল শুধু আত্মরক্ষা। কিন্তু প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সেনাকর্তারা এখন এক সুরে বলছেন, সেই যুগ অতীত। আত্মরক্ষা শুধু নয়, বিধ্বংসী প্রতি-আক্রমণের সক্ষমতাও তৈরি হয়ে গিয়েছে। আক্রমণ করা লক্ষ্য নয়। কিন্তু হামলা হলে, পাল্টা হামলায় চিনের ভিতরে যাতে ঢুকে যেতে পারে ভারতীয় বাহিনীও, সেই লক্ষ্যেই এখন এগোচ্ছে নয়াদিল্লি।

চিন-ভারতের বিবাদ মূলত সীমান্ত নিয়েই। চিনের এমন প্রায় কোনও প্রতিবেশী নেই, যে দেশের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে চিনের বিরোধ নেই। ভারতের সঙ্গেও চিনের বিবাদ সুবিদিত। ১৯৬২ সালে ভারত আর চিন যুদ্ধেও জড়িয়েছিল। সে সময়ে নেহাতই দুর্বল ভারতীয় বাহিনী বিভিন্ন ফ্রন্টে চিনের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল। তার পরও দীর্ঘ দিন চিন সীমান্তে উপযুক্ত সামরিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি ভারত। কিন্তু গত এক দশকে ছবিটা অনেকটা বদলে গিয়েছে। চিন সীমান্তে খুব নীরবে নতুন রণনীতির রূপায়ণ শুরু করে দিয়েছে ভারত। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তা কর্নেল সৌমিত্র রায় এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তেই চিনের সঙ্গে আমাদের সঙ্ঘাত সবচেয়ে বেশি। ১৯৬২-র যুদ্ধের পর থেকেই ওই সব সীমান্ত নিয়ে ভারতীয় সেনা অত্যন্ত সতর্ক। কিন্তু আমাদের নীতিটা আগে আলাদা ছিল। আমরা আগে শুধু ডিফেন্সিভ বা আত্মরক্ষামূলক নীতি নিয়ে চলতাম। অর্থাৎ চিন হামলা করলে কী ভাবে ঠেকাব, নিজেদের রণনীতি শুধু তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতাম। এখন কিন্তু আমদের নীতি ডিফেন্সের সঙ্গে কাউন্টার-অফেন্স বা প্রতি-আক্রমণ। অর্থাৎ চিন হামলা চালালে ভারতীয় বাহিনী যেমন এক দিকে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালাবে, অন্য দিকে বাহিনীর অন্য শাখা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে চিনের ভিতরে ঢুকেও পড়বে। তাতে আরও বেশি চাপে ফেলে দেওয়া যাবে প্রতিপক্ষকে।’’ অবসরপ্রাপ্ত এই সেনাকর্তার কথায় স্পষ্ট, ভারত নিজে চিনকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু চিন হামলা চালালে ভারত প্রতিআক্রমণে যাবে। শুধু আত্মরক্ষা চেষ্টায় নিজেদের আর সীমাবদ্ধ রাখবে না।

চিন সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর এই নতুন নীতি এখন লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশে খুব স্পষ্ট ছাপ ফেলছে। দেখে নেওয়া যাক সেই প্রস্তুতি কেমন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বায়ুসেনার উপস্থিতি অরুণাচলে বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে। নতুন রাস্তা এবং রেললাইন তৈরি হচ্ছে সীমান্ত বরাবর। আগে এই সড়ক এবং রেলপথ তৈরির কাজ এবং এলাকায় অন্যান্য পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ ইচ্ছাকৃতই করা হত না বলে কর্নেল রায়ের দাবি। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতীয় সেনা যেহেতেু আগে শুধু আত্মরক্ষার নীতি নিয়ে চলত, সেহেতু চিন সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল পরিকাঠামো বাড়ানো হত না। কারণ আমরা মনে করতাম, চিন যদি কোনও ভাবে ভিতরে ঢুকে আসে, তা হলে ওই সব সড়ক ও রেলপথ ব্যবহার করে চিন আরও সহজে ভারতের অনেক ভিতরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু এখন নীতি অন্য রকম। প্রতিআক্রমণ নীতি নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। তাই দ্রুত পরিকাঠামো বাড়ানো হচ্ছে অরুণাচল সীমান্তে।’’

শুধু যোগাযোগ পরিকাঠামো কিন্তু নয়, প্রত্যক্ষ রণসজ্জাও দ্রুত বাড়ানো হচ্ছে অরুণাচল প্রদেশে। গত কয়েক বছরে অরুণাচলে সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড বা সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি তৈরি করেছে ভারত। এই বিমানঘাঁটিগুলির অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬২-র যুদ্ধের পর থেকে সেগুলি মোটের উপর পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেগুলিরই মেরামতি এবং ব্যাপক আধুনিকীকরণ ঘটিয়ে চারটি অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড ইতিমধ্যেই অরুণাচলে বানিয়ে ফেলেছে ভারত। জিরো, আলং, মেচুকা এবং ওয়ালং— এই চারটি জায়গায় অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার অর্থাৎ ১৯ অগস্ট অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম সিয়াং জেলায় পাসিঘাট অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডও আবার খুলে যাচ্ছে। এতটাই আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়েছে পাসিঘাট বিমানঘাঁটিকে যে সব ধরণের আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং সুপার হারকিউলিক ১৩০জে-এর মতো দৈত্যাকার বিমানও ওঠানামা করতে পারবে সেখান থেকে। চিন সীমান্ত থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে এই পাসিঘাট। ফলে সেখান থেকে ভারতীয় যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চিনের বিভিন্ন সামরিক পরিকাঠামোয় বোমা বর্ষণ করতে পারবে।

সড়ক তৈরি, পরিকাঠামো বৃদ্ধি এবং এই পাঁচটি অ্যান্ডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড তৈরি করেই থেমে থাকছে না ভারত। আগামী আট-ন’মাসের মধ্যেই টুটিং এবং তাওয়াং-এ খুলে যাচ্ছে আরও দু’টি সীমান্তবর্তী বিমানঘাঁটি। অর্থাৎ অরুণাচল প্রদেশে চিনের সামনে দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর তৈরি করে ফেলছে ভারত।

শুধু অরুণাচল নয়, লাদাখকেও দুর্ভেদ্য করে তোলার পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে ভারত। লাদাখের দৌলত বেগ ওলদি এবং নিয়োমাতে দু’টি অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রথমটি সিয়াচেনের কাছে। সেখান থেকে চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে লাল ফৌজের বিভিন্ন ঘাঁটিতে খুব অল্প সময়ে আঘাত হানা যেমন সম্ভব, তেমনই পাক অধিকৃত কাশ্মীরে অভিযান চালানোও সহজ। আর নিয়োমা বিমানঘাঁটি থেকে হামলা চালানো যায় তিব্বতের মধ্যে চিনা বাহিনীর গড়ে তোলা বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে। জিনজিয়াং এবং তিব্বত, দুই এলাকাই চিনের জন্য কৌশলগত ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই এলাকাই স্বাধীনতার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে উত্তাল। সেই বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভারতকে চাপে রাখতে জিনজিয়াং ও তিব্বতে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরিকাঠামো বানিয়েছে পিপল’স লিবারেশন আর্মি। দৌলত বেগ ওলদি এবং নিয়োমাতে ভারতীয় বায়ুসেনার অ্যাডভান্সড ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড, সেই সব চিনা পরিকাঠামোর জন্য খুব বড় বিপদ, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এই দুই বিমানঘাঁটি স্তব্ধ করে দিতে পারে জিনজিয়াং-তিব্বত সংযোগকারী মহাসড়ককে এবং চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডকে।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা অরুণাচলেই বেশি। লাদাখে চিন-ভারতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে ঠিকই। চিনা সেনা মাঝে-মধ্যেই সেখানে সীমান্ত লঙ্ঘন করে ভারতীয় এলাকায় ঢুকেও পড়ে। কিন্তু নতুন করে এলাকা দখলের চেষ্টা সেখানে চিন এই মুহূর্তে করবে না।

অরুণাচল নিয়ে চিনের অন্য রকম আশঙ্কা রয়েছে। তাই ওই ভারতীয় প্রদেশকে বার বার দক্ষিণ তিব্বত বলে দাবি করার পরম্পরায় এখনও কোনও ছেদ নেই। অরুণাচল নিয়ে কী আশঙ্কা চিনের? উত্তর-পূর্ব ভারতে দীর্ঘ দিন কাজ করে আসা প্রবীণ সাংবাদিক রূপম বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘অরুণাচলে মাটির নীচে ইউরেনিয়ামের বিরাট সম্ভার রয়েছে বলে শোনা যায়। ভূপ্রকৃতি এতই দুর্গম যে সেই ইউরেনিয়াম তুলে আনা বেশ খরচ সাপেক্ষ। তবে সেই খরচ করার সামর্থ ভারতের এখন যথেষ্টই রয়েছে। চিনও তা জানে। তাই বেজিং অরুণাচল নিয়ে খুব চিন্তিত। ভারতের হাতে ইউরেনিয়ামের বিশাল সম্ভার থাকার অর্থ হল ভারতের পরমাণু প্রকল্পগুলির রমরমা। তা আটকাতেই অরুণাচলকে নিজেদের দখলে নিতে চায় বেজিং।’’

Indo-China Border India Fortifies Ladakh Arunachal Pradesh Huge Preparation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy