Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নোংরা জলে মাছ বাঁচে না, মানুষও না

পটনার রাজাঘাটের পাশেই গোসাঁইঘাট বস্তি। চার পুরুষ ধরে দেড়শো জেলের পরিবার এখানেই বসবাস করে।

বিপন্ন রুজি: বদ্ধ জলেই মাছের খোঁজ বাহাদুর-দশরথদের। নিজস্ব চিত্র

বিপন্ন রুজি: বদ্ধ জলেই মাছের খোঁজ বাহাদুর-দশরথদের। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
পটনা শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ০২:২৯
Share: Save:

একফালি জায়গার মধ্যে জল যেন থমকে গিয়েছে। স্রোত তো দূরের কথা, সামান্য নড়নচড়নও নেই। কচুরিপানা ভর্তি কয়েকটা জায়গায়। পাড়ের ধারগুলোয় আবর্জনা। অথচ আগে নাকি স্রোত উপচে পড়ত পাড়ে। তখন কী মাছ-কী মাছ! জাল ফেললেই ভর্তি করে মাছ উঠত। তার পরে তাদের লাফানো-ঝাঁপানো! কিন্তু সে-সব তো বহু দিন আগের কথা। এখন তো গঙ্গা দূরে, ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।

সন্ধে হব হব করছে। ম্লান আলোয় মুখটাও ম্লান হয়ে আসে দশরথ সাহনির। যে বদ্ধ, নোংরাভর্তি জলাশয়টুকু গঙ্গার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করেছে, তার পাড়ে দাঁড়িয়ে জালগুলো পরীক্ষা করছিলেন তিনি। পাশেই বাহাদুর সাহনি দাঁড়িয়ে। রাত নামছে। আবার জাল ফেলতে হবে। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি আর কি!

পটনার রাজাঘাটের পাশেই গোসাঁইঘাট বস্তি। চার পুরুষ ধরে দেড়শো জেলের পরিবার এখানেই বসবাস করে। পরিবার-পরিজন-বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভরন্ত সংসার। কিন্তু সেই সংসারেই অনিশ্চয়তার ছায়া। কারণ, ‘গঙ্গা মাইয়া’ আর আগের মতো নেই! হিন্দিতে দশরথ বলছিলেন, ‘‘আর বলবেন না! ঠাকুরদা, বাবার সময়েও কত মাছ উঠেছে। আমাদের যখন অল্প বয়স, কত মাছ ধরেছি। এখন আর মাছই ওঠে না।’’ তার পরে একটু থেমে বলে উঠলেন, ‘‘ইস গন্দে পানি মে মছলি ক্যায়সে জিয়েগা!’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গঙ্গার ‘গন্দে পানি’! আর তাতেই বিপন্ন হতে বসেছে দশরথ, বাহাদুরদের জীবন। কারণ, পটনায় গঙ্গার দূষণে মাছ বাঁচছে না। ‘নমামি গঙ্গে’ সামান্যতম আশ্বাসও দিতে পারেনি তাঁদের। বাধ্য হয়েই রুটিরুজির জন্য অন্য কিছু করতে হচ্ছে। ‘‘দিনের বেলা দিনমজুরির কাজ করে নেয় অনেকে বা রঙের কাজ করে। কেউ আবার গাড়ি চালানো শিখছে। রাতে শুধু মাছ ধরা হয়,’’ বলতে বলতে দূরে তাকালেন দশরথ।

কচুরিপানা, নোংরা ঠেলে কেউ নৌকা নিয়ে আসছে। বাহাদুর বললেন, ‘‘ওই দ্যাখ, বিনয় আসছে।’’ বিনয় পাড়ের কাছে এসে নৌকা থামালেন। বাহাদুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কথা হল?’’ বিনয় হতাশায় মাথা নাড়লেন। বাহাদুর বললেন, ‘‘আমরা তবু অন্য কাজ করি। ও তা-ও করত না। কিন্তু মাছ যদি না-ওঠে, তা হলে কী করে চলবে বলুন! সারা দিনে মাত্র দেড় কেজিতে কিছু হয়!’’ নৌকা বেঁধে বিনয় তত ক্ষণে পাড়ে উঠে এসেছেন। বললেন, ‘‘হল না! সব লোক নেওয়া হয়ে গিয়েছে।’’

জিজ্ঞেস করে জানা গেল, নমামি গঙ্গে-র আওতায় যে-সব ঘাট তৈরি হচ্ছে পটনায়, তা সাফাইয়ের জন্য লোক নেওয়া হচ্ছিল। সাফসুতরো ঘাট, ঘাটে বসার জন্য সুন্দর জায়গা। সে সব জায়গা সাফাইয়ের প্রয়োজন। তাই রুটিরুজি বিপন্ন হতে বসা বিনয়রা সদলবল সেখানে কাজের খোঁজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব লোক না কি নেওয়া হয়ে গিয়েছে! বিনয় বলছিলেন, ‘‘ঘরে এতগুলো লোক। গঙ্গায় মাছ নেই। চলবে কী করে!’’

প্রশ্নটা শুনে কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকলেন রবীন্দ্রকুমার সিনহা। ভুরু দু’টো সামান্য কোঁচকানো। বড় ঘর। বাইরে ‘ডু নট ডিসটার্ব’ বোর্ড ঝোলে সব সময়। কিছু ক্ষণ আগেই সেমিনার সেরে এসেছেন। বললেন, ‘‘দেখুন পটনার গঙ্গায় শিল্পের দূষণ নেই বললেই চলে। এখানে দূষণের মূল কারণ হল তরল বর্জ্য। অতীতে যখন সমীক্ষা করেছিলাম, তখন প্রতিদিন ২ কোটি লিটার তরল বর্জ্য গঙ্গায় পড়ত। এখন সেটা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।’’ পরিবেশবিদ তথা নালন্দা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রকুমার ‘ডলমিন-ম্যান’ নামেও খ্যাত। ২০০৯ সালে মনমোহন সিংহের সরকার যখন ডলফিনকে ‘ন্যাশনাল অ্যাকোয়াটিক অ্যানিম্যাল অব ইন্ডিয়া’র মর্যাদা দিয়েছিল, তাতে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু গঙ্গার ক্রমবর্ধমান দূষণ উদ্বেগের মাপকাঠিতে দশরথ, বাহাদুরদের সঙ্গে তাঁকেও একই বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রকুমারের কথায়, ‘‘গঙ্গার দূষণ সামুদ্রিক জীবচক্রকেই পাল্টে দিচ্ছে। দূষণের কারণে মাছ কমে যাচ্ছে গঙ্গায়। ফলে ডলফিনের সংরক্ষণ নিয়েও সমস্যা শুরু হয়েছে। একটা পূর্ণবয়স্ক ডলফিন দিনে গড়ে পাঁচ-ছ কেজি মাছ খায়। তা-ও জ্যান্ত।’’

পটনার কালীঘাটের সামনে চলছে নির্মাণ কাজ। কাছেই বহমান নিকাশি নালা। দূরে সরে যাচ্ছে গঙ্গা। নিজস্ব চিত্র

কিন্তু এমন হওয়ার তো কথা ছিল না! কারণ, গঙ্গা আন্দোলনের সঙ্গে পটনার নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এখন গঙ্গার অবিরল প্রবাহের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছে নানা জায়গায়, এক সময় সে আওয়াজ উঠেছিল বিহারের ভাগলপুর এলাকা থেকেই। ছোট-ছোট জেলে গ্রামে শুরু হওয়া গঙ্গামুক্তি আন্দোলনের মূল ধ্বনিই ছিল—‘গঙ্গা কো অবিরল বহনে দো।’ অতীতে গঙ্গামুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা বর্ষীয়ান রণজীব কুমারের কথায়, ‘‘গঙ্গা নিয়ে সব সরকারি পরিকল্পনা ব্যর্থ! নমামি গঙ্গেতে শুধু ঘাট বাঁধিয়ে বা বিজ্ঞাপন করে গঙ্গার হাল ফেরানো যাবে না। উল্টে নানা জায়গায় বাঁধ তুলে গঙ্গার অবিরল-নির্মল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে।’’

যেমন পটনার অন্যতম পুরনো ঘাট কালীঘাট। পুরনো কালীমন্দিরের স্থাপত্য, সিঁড়ির পাশাপাশি সেখানে নমামি গঙ্গে-তে নতুন ঘাট তৈরি হয়েছে। মন্দিরের সামনে থেকে শহরের বর্জ্য-সমেত নিকাশি নালা বয়ে যাচ্ছে। কিছুটা দূরে মিশছে গঙ্গায়। তার পাশেই ‘রিভারফ্রন্ট হাইওয়ে’ তৈরির কাজ চলছে। তার জন্য কৃত্রিম ভাবে জলপ্রবাহ বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

তাই বদ্ধ জল, বদ্ধ জীবন।

জাল পরীক্ষা করে ঘরমুখো দশরথ, বাহাদুর। ক্লান্ত বিনয় পাশে হেঁটে চলেছেন। মাথা নিচু। হঠাৎ বললেন, ‘‘জানেন আমার দু’টো ছেলে-মেয়ে। মেয়েটার বয়স ছ’বছর। ছেলেটার চার। ওদের পড়াচ্ছি। আমাদের কী হবে জানি না। কিন্তু ওরা যেন ঠিকঠাক থাকে।’’ অন্ধকার আর একটু ঘন হয়েছে। ‘পড়নে মে বহুত তেজ হ্যায় দোনো!’, আবারও বললেন বিনয়। প্রায়ান্ধকারেও আলো জ্বলে উঠল তাঁর চোখ-মুখে। পাশ থেকে দশরথ বলে উঠলেন, ‘‘আমার ছেলেমেয়েরাও কষ্ট করে পড়ছে। কারণ, এ ভাবে তো আর জীবন চলবে না! এ বার গঙ্গা মা আশীর্বাদ করলেই ওদের জীবনটা অন্তত ঠিক থাকবে!’’

প্রতিদিন আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিলেও দশরথ, বাহাদুরদের কাছে গঙ্গা ‘মা’-ই। তবে সেই মা, যে নিজে অপুষ্টিতে ভোগার কারণে সন্তানদের ভরণপোষণে ব্যর্থ! সে মায়ের উপরে রাগ করা যায়, অভিমান করা যায়। ছেড়ে যাওয়া যায় না। সেই মা-কে শেষ পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চান দশরথেরাও। নিজেরা ক্রমাগত হেরে যাচ্ছেন, কিন্তু চাইছেন, ছেলেমেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।

‘গঙ্গা মা’ শুধু সে আশীর্বাদটুকু করে দিক!

চাইছে গোটা গোঁসাইঘাট বস্তি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE