Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-journalist

সে বার সরকার বাঁচাল সুরত, কিন্তু ব্যবসাটা বাঁচল না, ক্ষোভ হিরে ব্যবসায়ীর

গোটা বিশ্বে যত হিরে দেখা যায় তার ৯০ শতাংশ এই সুরতেই কাটা হয়। আর ভারত যে হিরে রফতানি করে বিদেশে তার ৮০ শতাংশই এই সুরত থেকে যায়। গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ লাখ লোক কাজ করতেন। তাঁরা থাকতেন এই সুরতেই। তবে গত কয়েক বছরে সংখ্যাটা কমে গিয়েছে।

সুরতের হিরে বাজারের ‘ডায়মন্ড ভিলেজ’। নিজস্ব চিত্র।

সুরতের হিরে বাজারের ‘ডায়মন্ড ভিলেজ’। নিজস্ব চিত্র।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী
সুরত শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ২১:৫৫
Share: Save:

এটাই কি হিরে বাজার?

কিলবিল করছে লোক। রাস্তাটা ফুট পনেরো চওড়া হবে। তার এ পাশ ও পাশে ঢুকে পড়েছে গলি। সব দিকেই উঁচু উঁচু বাড়ি। রাস্তা থেকে বাড়ি— সর্বত্রই ভিড়। ঘড়ি মানলে দুপুর সবে গড়িয়েছে বিকেলে। কিন্তু, পশ্চিমের এই রাজ্যে সূর্য দেরিতে অস্ত যায় বলে মনে হবে ভরদুপুর! কেউ চা খাচ্ছেন তো কেউ আলোচনায় ব্যস্ত। তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকা এক জনকে প্রশ্নটা করে জবাব পাওয়া গেল, ‘‘হ্যাঁ, এটাই সুরতের হিরে বাজার।’’ উত্তরটুকু দিয়েই ফের ঢুকে পড়লেন আলোচনায়।

অস্বস্তিকর হলেও তাঁকে ডেকেই ফের প্রশ্ন করা গেল, রাস্তায় এত লোক কেন? ভোটের বাজারে কোনও নেতা আসবেন?

একটু বিরক্ত হয়ে তাকালেন। পরে জেনেছি, তাঁর নাম অনন্ত নাভাড়িয়া। বললেন, ‘‘এটা হিরে বাজার। এখানে এমন ভিড়ই থাকে। এখন তো তা-ও কম দেখছেন। আগে আরও ভিড় লেগে থাকত।’’ আর আপনারা? ‘‘আমরা সব ব্রোকার। মানে দালাল। আমরাই এখানে হিরে কেনা-বেচা করি,’’ বললেন অনন্ত। এ বার পাল্টা আগন্তুকের পরিচয় জানতে চাওয়ার পালা। সংবাদিক পরিচয় জেনে, একটু থমকে গেলেন। তার পর অনন্ত বললেন, ‘‘এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।’’ মুখটা এমন ভাবে ঘুরিয়ে নিলেন, আর কথা বাড়ানো যায় না। কিছু সময় সেই ভিড়ে কাটিয়ে বোঝা গেল, ‘ধান্দা’ ছাড়া এখানে বোধহয় মুখ খোলা বারণ!

সামনেই ‘ডায়মন্ড ভিলেজ’। হিরে বাজারের ভিতরেই এক বহুতল। সব ক’টা ফ্লোরেই ছোট ছোট খুপরির মতো ঘর। সেখানে জ্বলছে সাদা আলো। তার নীচে চলছে হিরের পরীক্ষানিরীক্ষা, কেনা-বেচা। ঢুকে পড়া গেল তেমনই এক ছোট ঘরে। ঘর বলতে সাত ফুট বাই সাত ফুট। ভিতরে সাদা আলোর ফুলঝুরি। গোটা কয়েক চেয়ার। মাঝখানে একটা টেবিল। তার উপরেই রাখা ঝকমকে হিরে। অজস্র। চলছে তার মান যাচাই। অচেনা লোক ঢুকতে দেখেই, আটকে দিলেন। তিনিই সম্ভবত এই ছোট্ট ঘরের মালিক। পরিচয় দিয়ে জানানো গেল, ভোট দেখতে আসার সুবাদেই হিরের রাজ্যে ঢুকে পড়া। ঢুকতে দিলেন ঘরের ভিতরে। একটা চেয়ারে বসতেও বললেন।

হিরের মান যাচাইয়ের কাজে ব্যস্ত কর্মীরা।

কথাবার্তা চলছে। ওঁর নাম পরেশ পটেল। উত্তর গুজরাতের পালংপুর থেকে কয়েক দশক আগে এসেছিলেন ওই সুরতে। তার পর হিরে পালিশের কাজ থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে এই হিরে ব্যবসায়ীর জায়গায় নিয়ে আসা। কিন্তু, এখন ব্যবসা কেমন? জিএসটি, নোটবন্দি— এই দুই ধাক্কায় হিরে-শিল্প নাকি নাকানিচোবানি খাচ্ছে? তত ক্ষণে চা চলে এসেছে।

চেয়ারের উপরেই বাবু হয়ে বসলেন পরেশ। তার পর চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক, বললেন, ‘‘দেখুন জিএসটি বা নোটবন্দি তো আছেই। কিন্তু তার প্রভাবে ব্যবসায় এমন মন্দা এসেছে তেমনটা বলতে পারব না। আসলে গোটা ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রিই সব মিলিয়ে একটা সমস্যায় পড়েছে।’’ কী রকম? পরেশ বলে চললেন, ‘‘প্রথমে নোটবন্দি এবং পরে জিএসটি ব্যবসায় ভাটা এনেছিল। নীরব মোদী পালানোর পর ব্যাঙ্ক আমাদের আর ঋণ দেয় না। একই সঙ্গে বিশ্ব বাজারে বেশ কয়েক মাস ধরে হিরের চাহিদা কমে গিয়েছে। ফলে যে না-কাটা হিরে আমরা আমদানি করেছি, তা কাটাইয়ের পর অর্থাৎ পালিশ করে আর বাজার পাচ্ছে না। গোটা ব্যবসাটাই কেমন মার খাচ্ছে। না হলে বাইরে যে দালালদের ভিড় দেখলেন, তার দ্বিগুণ থাকে এই সময়ে।’’

ওঁর কাছেই জানা গেল, গোটা বিশ্বে যত হিরে দেখা যায় তার ৯০ শতাংশ এই সুরতেই কাটা হয়। আর ভারত যে হিরে বিদেশে রফতানি করে তার ৮০ শতাংশই এই সুরত থেকে যায়। গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ লাখ লোক কাজ করতেন। তাঁরা থাকতেন এই সুরতেই। তবে গত কয়েক বছরে সংখ্যাটা কমে গিয়েছে। অন্তত লাখ দেড়েক লোক এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। কথায় কথায় পরেশ বললেন, ‘‘জানেন, নীরব মোদীর গ্রামের বাড়ি কিন্তু আমার জেলায়। পালংপুর।’’

হিরে বাজারের একটি দোকান।— নিজস্ব চিত্র।

তবে ব্যবসার এই হাল নিশ্চয়ই এ বারের ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলবে? পরেশের পাশে বসে এত ক্ষণ হিরে পরীক্ষায় মনোযোগী যুবকটি মুখ খুললেন। পরেশের ওই ব্যবসায়িক সহযোগী জানালেন, ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই নোটবন্দি, জিএসটি বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল। ব্যবসায়ীদের মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষোভ ছিল। হর্ষদ সিন নামের ওই যুবকের কথায়, ‘‘সে বার তো সকলে ভেবেছিলেন গুজরাতে বিজেপি উল্টে গেল। কিন্তু এই সুরতই বাঁচিয়েছিল বিজেপিকে। সরকার বাঁচলেও আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু বাঁচেনি।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

পরেশের ওখান থেকে বেরিয়ে দু’মিনিটের পথ কাঁসারা স্ট্রিট। মোড়ের চায়ের দোকানেই আলাপ হল ঝাড়গ্রামের স্বপন মাহাতোর সঙ্গে। বছর দশেক সুরতে রয়েছেন। পরিবার নিয়েই। ভোট যদিও পশ্চিমবঙ্গে। তবে এ বার বাজার মন্দা। তাই ভোট দিতে আসবেন না। রাজ্যে ভোটের বাজার কেমন প্রথমেই জানতে চাইলেন। যদিও টিভির দৌলতে তিনি প্রায় সবটাই জানেন। তার পর আসা গেল সুরতের প্রসঙ্গে। স্বপন জানালেন, তিনি এখানে একটা কারখানায় হিরে কাটাইয়ের কাজ করতেন। সেখানে দিনপ্রতি ৫০০ টাকা মিলত। কিন্তু নোটবন্দির সময়ে সেই কারখানা মালিক মাইনে দিতে পারছিলেন না। তাই কাজ ছেড়ে অন্য একটা কাটাই কোম্পানিতে কাজ জোটান স্বপন। সেখানে মাসমাইনের ব্যবস্থা। মাসে ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু বছর ঘুরতেই জিএসটির চাপে সেই চাকরি যায়। এখন এই হিরে বাজারে দালালির কাজ করেন।

আরও পড়ুন: ‘খান ইয়া বান’, ঔরঙ্গাবাদ জুড়ে ‘সুরক্ষা’র মায়াজাল

কী হবে এখানকার ভোটে?

হর্ষদের মতোই বললেন স্বপন। ‘‘বিধানসভায় যে ভাবে এখান থেকে বিজেপি জিতল, তাতে মনে হচ্ছে লোকসভায় হয়তো ওরাই জিতবে। কিন্তু হিরে শিল্পটাই তো ধুঁকছে এখানে। সেটা বাঁচানোর দরকার।’’ বড় ব্যবসায়ীদের কী অবস্থা? স্বপন বললেন, ‘‘সকলেরই একই অবস্থা। কেউ ভাল নেই দাদা। কত লোক এই কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে!’’

আরও পড়ুন: পটেলমূর্তির নামেই কেবল ‘ইউনিটি’, একাত্মবোধ হারিয়ে গিয়েছে নর্মদায়

যারা ছাড়লেন তাঁরা কোথায় গেলেন? স্বপন জানালেন, কাটাইয়ের কাজে মূলত গুজরাতের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের শ্রমিকরাই কাজ করতেন। তাঁদের অনেকে গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। কেউ কেউ দালালির কাজে ঢুকেছেন স্বপনের মতো। কেউ আবার হিরে ছেড়ে বস্ত্র শিল্পে ঢুকেছেন।

হিরে বাজারের কথাটা মেনে নিলেন জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট কাউন্সিলের আঞ্চলির সভাপতি দীনেশ নাভাড়িয়া। তিনি যদিও গোটাটার জন্য ব্যাঙ্কের ‘অতি তৎপরতাকেই’ দায়ী করছেন। বললেন, ‘‘নীরব মোদীর ঘটনার পর হিরে ব্যবসায়ীরা যে ঋণ নিয়েছিলেন, তার ৩০ শতাংশ অনতিবিলম্বে শোধ করতে বলা হয়। টাকা না থাকলে আপনি ব্যবসায় খাটাবেন কী! সেটার একটা বড় প্রভাব তো ব্যবসায় পড়েইছে।’’

সেই প্রভাব কতটা ভোটে পড়বে? বিজেপি নেতাদের দাবি, তাঁরাই জিতছেন। কারণ, বিধানসভায় সে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আর কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছেন, এত মানুষের পেটে হাত পড়েছে, তার পরে আর কেউ বিজেপির কথা ভাবছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE