Advertisement
E-Paper

পটেলমূর্তির নামেই কেবল ‘ইউনিটি’, একাত্মবোধ হারিয়ে গিয়েছে নর্মদায়

তা হলে ভোট এ বার কোন বোতামে? সরাসরি প্রশ্ন করে জবাব পেলাম, ভাজপ (বিজেপি)-কে দেবই না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু, কংগ্রেসকে দিলে কি আর আমাদের সেই গ্রাম, সেই চাষবাষ ফিরবে?

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’। নিজস্ব চিত্র।

‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’। নিজস্ব চিত্র।

এখানেও বাঙালি! ‘‘দেখেছেন মশাই কেমন আঁটঘাঁট বেঁধে ব্যবসায় নেমেছে! মোদী তো শিব্রাম চক্কোত্তিকে মনে পড়িয়ে দিলেন,’’ সর্দার বল্লভভাই পটেলের দিকে তাকিয়ে কথাটা পাড়লেন নৈহাটির অনির্বাণ পাল।

সস্ত্রীক এসেছিলেন সোমনাথ মন্দির দর্শনে। কলকাতা ফেরার আগে হাতে এক দিন সময় ছিল। তাই আমদাবাদ থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের এই ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ দেখতে এসেছেন। অনির্বাণবাবু পেশায় ব্যবসায়ী। তাই ব্যবসার গন্ধটা শুরুতেই নাকে পেয়ে গিয়েছেন বোধহয়!

সদ্য টিকিট কেটে পৌঁছেছি বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তির কাছে। ৫৯৭ ফুটের বল্লভভাই পটেল দাঁড়িয়ে রয়েছেন একেবারেই একা। ব্যাকড্রপে সাতপুরা এবং বিন্ধ্যাচল পর্বত। একটু সামনে নর্মদার উপর সর্দার সরোবর বাঁধ। কড়া রোদ। নীচে জোরকদমে কাজ চলছে। শেডের তলা দিয়ে হাঁটছেন সকলে। ফের অনির্বাণবাবুর বিরক্তিসূচক মন্তব্য, ‘‘কিছুই নেই। এতটা দূর। তুমুল গরম। তার মধ্যেও কেমন লোকজন এসেছেন দেখছেন! প্রোমোশন, বুঝলেন মশাই সবটাই প্রোমোশন। আর তার জোরেই এই কিছু না-কে একটা এত্ত বড় বিষয় বানিয়ে ছেড়েছেন মোদী। প্রকৃত বেনিয়া!’’

২০১৮-র ৩১ অক্টোবর মূর্তি উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।

তা ‘আঁটঘাঁট বেঁধে ব্যবসা’টা কোথায় দেখলেন? এ বার নিজের বিরক্তিকে পুরোটা খুললেন বাঙালি প্রৌঢ়। কাছাকাছির মধ্যে কোথাও কোনও রেল স্টেশন বা বিমানবন্দর নেই। গাড়িই ভরসা। আমদাবাদ থেকে ২০০, আর কাছের শহর বদোদরা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার। অনেকে আবার বাস ভাড়া করে আসছেন। ধু-ধু আধা-পাহাড়ি গ্রামীণ এলাকায় থাকার জায়গা প্রায় নেই। নতুন বানানো সরকারি গেস্ট হাউস ‘ভারত ভবন’ বা ‘টেন্ট সিটি নর্মদা’ বানানো হয়েছে, সেখানে থাকতে গেলে ভাল মতো রেস্ত খরচ করতে হয়। কেবাড়িয়া থেকে এই মূর্তি প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। কিন্তু ওই পথ গাড়িতে যেতে গেলে পার্কিং ফি ১৫০ টাকা। আছে বাসের ব্যবস্থা। তাতে জনপ্রতি ৩০ টাকা।

এখানেই শেষ নয়। মূর্তির কাছে যাওয়ার জন্যও রয়েছে নানাবিধ খরচ। যেমন বল্লভভাইয়ের পাদদেশ অবধি পৌঁছতে ১২০ টাকার টিকিট। লিফ্টে করে মূর্তির বুকের কাছ থেকে ‘বার্ডস আই ভিউ’ দেখতে ৩৫০ টাকা। আর যদি লাইনে দাঁড়াতে না চান, তা হলে রয়েছে ১ হাজার টাকার টিকিট। এ ছাড়া কেবাড়িয়া থেকে মূর্তি এবং পার্শ্ববর্তী সর্দার সরোবর বাঁধ এলাকায় ১০ মিনিটের হেলিকপ্টার-ভ্রমণ হয়। তার জন্য ২ হাজার ৯০০ টাকা মতো খরচ।

আরও পড়ুন: কচ্ছের রানে যেন গণতন্ত্রের লবণ অভিযান

এত ফিরিস্তি এ কারণেই দেওয়া যে এই বিপুল খরচ করে ৪৩ ডিগ্রির দুপুরেও লোকজন আসছেন। আমদাবাদ থেকে যেমন অমিতভাই চৌহান এসেছেন সপরিবার, বল্লভভাই পটেলকে দেখতে। বলছিলেন, ‘‘টিভিতে-কাগজে এত ছবি দেখেছি, এক বার নিজের চোখে না দেখলে হয়! আমাদের রাজ্যে এমন একটা বিষয়, যা দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে লোকজন আসছেন, আসব আসব করে আর আসাই হয়নি। আজ চলে এলাম।’’ তাঁর স্ত্রী নেহার কথায়, ‘‘বাচ্চাদের শুধু তো বই পড়ালেই হবে না। সর্দার পটেল আমাদের জাতির গর্ব। তাঁর মূর্তি আর মিউজিয়াম এই বয়সে দেখলে বিষয়টা মাথায় গেঁথে থাকবে।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এটাকেই প্রচারের ফল বলে মনে করছেন অনির্বাণবাবুর স্ত্রী শুভ্রা পাল। তিনি তো বলেই ফেললেন, ‘‘আমাদের রাজ্যের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে এখানে এসে। ধরুন, বিষ্ণুপুর। এই গরমে আমরা সেখানে কেউ যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না সরকারি কোনও উদ্যোগ নেই। প্রচার নেই। আর এরা দেখুন কেমন প্রচারেই জিতে যাচ্ছে। আমরা হেরে ভূত!’’

মূর্তির পাদদেশে যাওয়ার জন্য চলছে সিকিউরিটি চেক-ইন।—নিজস্ব চিত্র।

কেমন লোকজন হচ্ছে? কেবাড়িয়ার ট্যুরিস্ট পয়েন্ট বা সাড়ে তিন কিলোমিটার পেরিয়ে আসার পর টিকিট কাউন্টার— কর্মীদের কথায়, ‘‘প্রচুর লোক হয়। শনি-রবি ভিড় বেশি।’’ কী রকম? ‘‘প্রতি দিন আমরা ৩৫০ টাকার টিকিট ৭ হাজার বিক্রি করতে পারি। শনি-রবিবার দুপুরের মধ্যেই সেটা ফুরিয়ে যায়,’’—বললেন টিকিট কাউন্টারের এক কর্মী। এই হিসেবই জানিয়ে দিচ্ছে ‘ব্যবসা’ ভালই হচ্ছে। ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ বলে কথা!

কিন্তু ‘ইউনিটি’ শব্দটা যে শুধু মূর্তির নামেই রয়েছে সেটা টের পাওয়া গেল ঘণ্টাখানেকের মূর্তি-দর্শন শেষে। যে ছ’টা গ্রাম মুছে এই বিপুল মূর্তি এবং পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তারা যে একাত্ম হতে পারেনি এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে! বেরনোর সময় ভূমিকা তাড়ভি নামের এক তরুণী নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখানে আগে কী ছিল? প্রশ্নটা করা মাত্রই তরুণীর চোখে একটা বিদ্যুতের রেখা দেখা গেল। একটু কি ঝাঁঝ গলায়? শোনালেন, ‘‘কী ছিল মানে? গ্রাম ছিল। এটা গোরা গ্রামের মধ্যে পড়ে।’’ কথায় কথায় জানা গেল, পাহাড়-গ্রাম সরিয়ে এখানে বল্লভভাই পটেলকে বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬টা গ্রাম এখনও অধিকৃত হয়েছে— গোরা, লিমড়ি, নয়াগাঁও, ওগাড়িয়া, কেবাড়িয়া এবং কোঠী। তালিকায় আরও রয়েছে। কারণ এখানে সাফারি তৈরি হবে। বাড়ানো হবে পর্যটন কেন্দ্রের ম্যাপ। আর তাতেই পড়ে গিয়েছে আরও অনেক গ্রাম। ভূমিকা লিমড়িতে থাকেন।

কিন্তু কোথাও পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হওয়া মানে তো স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়া! কথাটা শুনে রেগে গেলেন কৌশিক তাড়ভি। বছর তেইশের কৌশিকও বেসরকারি সংস্থার হয়ে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন এখানে, ভূমিকার মতোই। তাঁর কথায়, ‘‘এত লোক আসছে তাতে আমাদের লাভ কি? আমাদের তো এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্যত্র। বাপ-ঠাকুরদারা সেই কোন আমল থেকে এখানে চাষ-আবাদ করেই দিন কাটিয়েছে। আর নিজেদের গ্রামেই এখন আমরা ভিনদেশি। কবে কোথায় চলে যেতে হয়! এর কোন সুফলটা আমরা পাব?’’ ওঁরা এই কাজে দিন প্রতি ৪০০ টাকা পান। কৌশিক থাকেন গোরা কলোনিতে। গ্রাম ছেড়ে গেলে এই অস্থায়ী চাকরিটাও যে ছেড়ে দিতে হবে!

গোরা গ্রামে ঢোকার মুখে...

ওঁর কাছ থেকেই গোরা যাওয়ার পথটা জেনে নেওয়া গেল। মূর্তি থেকে মেরেকেটে তিন কিলোমিটার হবে। সেই গ্রাম ঘুরে টের পাওয়া গেল একাত্মতার কোন রং লেগে আছে নরেন্দ্র মোদীর বহু আহ্লাদিত এই ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’র গায়ে। গ্রামে ঢুকতেই ছোট্ট দোকান কন্নুভাই তাড়ভির। স্ট্যাচুর কথা শুনেই যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বেশ চাষ-আবাদ করে দিন কাটাচ্ছিলেন। জলের ভয়াবহ সমস্যা ছিল। কিন্তু, তার মধ্যে মকাই, অড়হর, জোয়ার, বাজরা— এ সব হত। তাতেই সংসার চলে যেত মোটামুটি ভাবে। কিন্তু, বল্লভভাইয়ের মূর্তি বসার আগেই তাঁদের সব গিয়েছে। তিনি বলছিলেন, ‘‘জমির দাম পাইনি এখনও। ফসলের দাম ধরে দিয়েছে। বাকি টাকা কবে মিলবে জানি না। চাষ বন্ধ করে এখন এই ছোট্ট দোকান খুলেছি। টুকটাক চলে। তার মধ্যে শুনছি, এখান থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের দহিডে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওখানে তো নোনা জল। কী করে চাষ করব!’’

তা হলে ভোট এ বার কোন বোতামে? সরাসরি প্রশ্ন করে জবাব পেলাম, ‘‘ভাজপ (বিজেপি)-কে দেবই না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু, কংগ্রেসকে দিলে কি আর আমাদের সেই গ্রাম, সেই চাষবাষ ফিরবে?’’

এ সবের মধ্যেই নিজের গায়ে ইউনিটি-র তকমা লাগিয়ে একেবারে একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছেন বল্লভভাই পটেল। বিশ্বের সর্বোচ্চ মূর্তি!

Lok Sabha Election 2019 Statue of Unity Narmada Gujrat Narendra Modi লোকসভা ভোট ২০১৯ স্ট্যাচু অব ইউনিটি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy