তামিল রাজনীতির বর্ণময় এই দুই চরিত্রই আর নেই।
মাথার উপর সূর্য। রোদের তাপ এড়াতে মাঠে চড়ে বেড়ানো গরু-ছাগলও কোনও গাছের তলায় ছায়া খুঁজে ঝিমোচ্ছে। কিন্তু সেই বিলাসিতাটুকুর সুযোগ নেই চিত্রা, শিবানী বা সুধার। চড়া রোদ উপেক্ষা করেই তাঁরা বসে আছেন রাস্তার ধারে সরকারি জলের কলের সামনে। আগের দিন জল আসেনি। ভরা গ্রীষ্মে সবার ঘরেই জল বাড়ন্ত! জল না ভরতে পারলে রাতে খাবার জলও জুটবে না।
বসে থাকতে থাকতে থাকতেই সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যায়। রাস্তার ধারের কালো ফাইবারের ট্যাঙ্কে জল ভরার আওয়াজ কানে আসতেই শুরু হয়ে যায় চূড়ান্ত ব্যস্ততা। রং-বেরঙের প্লাস্টিকের কলসি-ঘড়া নিয়ে জল ভরা শুরু হয়ে যায়। হাত লাগান বাড়ির পুরুষরাও। পরনের লুঙ্গিটা গুটিয়ে জলের ঘড়াটা তুলতে তুলতে বলছিলেন ডিন্ডিগুলের রামনগরপুরমের এম সম্মুগম— ‘‘যতটা পারা যায় জল নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে। কাল ফের জল পাওয়া যাবে কি না জানিনা।”
জলের জন্য হাহাকারের ছবিটা শুধু রামনগরপুরমের নয়। রাজ্যের উত্তর প্রান্তে কর্নাটক সীমানার ধর্মপুরী, কৃষ্ণগিরি থেকে মধ্য তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি পর্যন্ত, এমনকি সাগরপাড়ের নাগাপট্টিনম জেলার প্রান্তে প্রান্তে জলের এই হাহাকার এখন খুব সাধারণ দৃশ্য। নির্বাচন ঘোষণার আগেই রাজ্য সরকার ৩২টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলাকেই খরা কবলিত ঘোষণা করেছে। ভিল্লাপুরম জেলার কুত্থানুরের বাসিন্দা ভেঙ্কটেশ। তাঁর কথায়, গত তিন বছরে ছবিটা বদলায়নি। দাক্ষিণাত্যের এই রাজ্যে কৃষি নির্ভর করে উত্তর পূর্ব মৌসুমী বায়ুবাহিত শীতকালীন বৃষ্টিপাতের উপর। কিন্তু গত তিনবছর সেই বৃষ্টিপাত প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই কম যে খরা পরিস্থিতি রাজ্যের অর্ধেক জায়গা জুড়ে। মাঠেই জল না পেয়ে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে ফসল। ঋণে জর্জরিত কৃষকদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ঋণ মুক্তির দাবি নিয়ে বারে বারে দিল্লিতে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন কৃষকরা। কৃষক আন্দোলনের নেতা আয়াকান্নুর অভিযোগ, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ইকে পলানীস্বামীর মৌখিক আশ্বাস ছাড়া কিছুইপাননি কৃষকরা। তামিল কৃষকদের দিকে ফিরেও তাকায়নি মোদীর সরকার।”
জয়ললিতার কাটআউটে দুধ ঢেলে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ভক্তরা। ছবি: পিটিআই।
আরও পড়ুন: দিদির অপমান? নৈব চ! তাই খোঁচা দিয়েও জামাইবাবুর মান বাঁচিয়ে ফিরছেন দুর্গাপুরের মেয়র পারিষদ
হাহাকারের শব্দটা কানে আসে রাজ্যের উত্তর পশ্চিম প্রান্তের ‘ডলার সিটি’ তিরুপুরেও। রেডিমেড জামাকাপড়ের শিল্পের জন্য বিখ্যাত এই শহর পণ্য রফতানি করে রাজ্যে নিয়ে আসে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা। সে কারণেই অনেকে তিরুপুরকে বলেন ডলার সিটি। ক’বছর আগেও এই শহরে প্রচলিত ছিল, ‘নেত্রায়া থোড়িলালি,ইন্দ্রায়া মুথালালি।’ অর্থাৎ আজকে কর্মচারী, কাল মালিক। কে এস বাবু, তিরুপুরের একজন ছোট ব্যবসায়ী। তিনি বলেন,‘‘ওই প্রবাদ এখন অতীত। এখন আমরাই নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে বড় কোম্পানিতে চাকরি করতে যাচ্ছি।” বাবুরা শোনাচ্ছিলেন, কীভাবে মোদী সরকারের জিএসটি আর নোটবন্দি কপাল পুড়িয়েছে ছোট উদ্যোগপতিদের।
বাবুদের হাহাকার চাপা দিয়ে মাইকে প্রচার করতে করতে এগিয়ে গেল জোড়া পাতা প্রতীক আঁকা একটা মিনিট্রাক। এমজিআর-জয়ললিতার ছবি দেওয়া এআইএডিএমকের দলীয় পতাকার সঙ্গে এক সারিতে বিজেপির পদ্মফুল দেওয়া পতাকা। রয়েছে জোটের বাকি দলেরও পতাকা। প্রচার গাড়ির পেছনে বাইকে, হেঁটে কয়েকশো মানুষ।
দৈত্যকার কাটআউট এখন অতীত। মাদ্রাজ হাইকোর্টের নির্দেশে কাটআউট নিষিদ্ধ। ছবি: রয়টার্স।
বাবুরই জামার কলার তৈরির কারখানায় কাজ করতেন বছর পয়ষট্টির নরসীমন। মিছিলের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘‘প্রার্থী এমএসএম অনন্থনের সভা আছে সামনের মাঠে। তিনি আবার রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রী।’’ মিছিলে পতাকা হাতে যুবকদের দেখিয়ে তিনি বলেন,‘‘সবাই নগদ ২০০ টাকা পেয়েছে। সঙ্গে টিফিন আর এক বোতন বিয়ার। যাঁরা বাইকে আছে তাঁরা ৪০০ টাকা পেয়েছে।” নরসীমন নিজের জামার দুটো বোতাম খুলে বুকের বাঁদিকে উল্কি করা এমজিআরের মুখের ছবি দেখিয়ে আক্ষেপের স্বরে বলেন,‘‘আমরা পয়সার জন্য যেতাম না। আমরা এমজিআরকে দেখতে পায়ে হেঁটে ১০ কিলোমিটারও গিয়েছি। এরপর আম্মাকেও দেখতে যেতাম। এখন কাকে দেখতে যাব?”
আরও পড়ুন: কংগ্রেসের প্রচার মধ্যগগনে, মোদির জন্যে কি ঝুলে রয়েছে ইনদওর, বিদিশা, ভোপাল?
নরসীমনের কথা শুনে অবাক হলাম না। কারণ তাঁরই মতো নাগাপত্তিনামের এস রবিকুমার হাতে উল্কি করা জোড়া পাতা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘সবাই এখন ভোট কিনতে টাকা নিয়ে আসছে। আমি কখনও টাকার জন্য ভোট দিইনি। আমার প্রাণের দেবতা এমজিআরকে দিয়েছি।” কান পাতলেই শোনা যায় সাম্প্রতিক এক উপনির্বাচনে রাজ্যের দুই প্রধান ডিএমকে-এডিএমকে-র ভোটের ‘নিলাম’ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাঁরা ভোটার পিছু পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতেও পিছু পা হয়নি। যেমন এবারও তাঁরা হচ্ছেন না। শুধু ভোটার নয়, দলীয় কার্যকর্তাদেরও রীতিমতো কর্পোরেট কায়দায় ভোট পারফরম্যান্সের উপর ঘোষণা করা হয়েছে ‘ইনসেনটিভ’। বিদেশ ভ্রমণ থেকে টিভি, মোটর বাইক সবই আছে সেই প্যাকেজে। ডিএমকে-র আইটি সেলের অন্যতম সহ-সম্পাদক সুধাকরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই লাজুক হাসি দিয়ে বলেন,‘‘আপনারা অপব্যাখ্যা করছেন। এ সবই দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করতে।”
পুরনো এই জৌলুস আর নেই তামিল রাজনীতিতে। ছবি: রয়টার্স।
তাহলে কি উৎসাহ পাচ্ছেন না দলীয় কর্মীরা? পোলুরের বর্ষীয়ান ডিএমকে বিধায়ক কে বি শেখরণ স্বীকার করে নেন,‘‘আন্না(করুণানিধি)-র সেই সম্মোহন এখনকার কোনও নেতার মধ্যে কোথায়? আমরা স্ট্যালিনকে নেতা মানি। কারণ তিনি আন্নার মনোনীত নেতা। কিন্তু এখনও তিনি আন্নার ছায়ায় ঢাকা।”
গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রুপোলি পর্দা থেকে রাজনৈতিক ময়দানে তামিলভূমের মানুষকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন এমজিআর,আম্মা, আন্নারানিজেদের জনমোহিনী ক্ষমতায়। একার হাতে দল টেনে নিজেদের নিয়ে গিয়েছেন কিংবদন্তির পর্যায়ে। দৈত্যাকার কাটআউট, জনমোহিনী ঘোষণা, সর্বোপরি নিজেদের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যারিশ্মার তলায় অনায়াসে চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন দুর্নীতি, স্বজনপোষন, স্বৈরাচারের অন্ধকারকে।
দিল্লির যন্তর মন্তরে বিক্ষোভ খরা পীড়িত তামিল কৃষকদের। ছবি: পিটিআই।
এ বারের নির্বাচনে এঁরা কেউ নেই। কিন্তু না থেকেও তাঁরা আছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কাপড় ঢাকা মূর্তির আড়ালে, পতাকা থেকে দেওয়াল লিখনের ছবিতে, প্রচারগাড়িতে বা সভায় মাইকে বাজানো পুরনো বক্তব্যে। সদ্য সম্মোহনের ঘুম থেকে ওঠা মানুষের চোখ খুঁজছে এঁদের। যেমন খুঁজছেন নরসীমন, রবিকুমাররা। দলের বর্তমান ইপিএস-ওপিএস (মুখ্যমন্ত্রী পলানীস্বামী এবং তাঁর ডেপুটি পনীরসেলভম)জুটি মন ভরাতে পারছে না তাঁদের।
ইপিএস-ওপিএস বা স্ট্যালিনের না থাকুক, রুপোলি জগতের সেই ছ্বটা রয়েছে অভিনেতা কমল হাসন বা রজনীকান্তের। দু’জনেই রাজনীতির ময়দানে পা দিয়েছেন। টর্চ চিহ্ন নিয়ে নির্বাচনে শামিল কমল হাসন। কিন্তু তামিল জনমানসে এখনও আলো জ্বালতে ব্যর্থ কমলের টর্চ। আর সে কারণেই বোধহয় নির্বাচন থেকে দূরে থেকে জল মাপছেন রজনীকান্ত।
জলের হাহাকার। অর্ধেক তামিলনাড়ুকে খরা কবলিত ঘোষণা করেছে সরকার।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: টাকা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা! ভেলোরে নির্বাচন বাতিলের সুপারিশ কমিশনের
খরা কি কেবল চাষের জমিতে? না কিএকই হাহাকার জৌলুস হারানো তামিল রাজনীতিতেও? ডিএমকের যুব শাখার ধর্মপুরী জেলার সম্পাদক আলাগু সুশীন্দ্র। তামিল রাজনীতি যে জৌলুস হারিয়েছে তা এক কথায় মেনে নেন সুশীন্দ্র। তবে তাঁর আশা,‘‘একটু সময় দিন নতুন নেতাদের। হয়তো আবার হারানো মেজাজ ফিরে পাবে আমাদের রাজনীতি।”কিন্তু রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে বার বার নোটবন্দি,জিএসটি, মোদী, রাহুল প্রসঙ্গ শুনতে শুনতে ধন্দ জাগে। তামিল রাজনীতির এই নেতৃত্বের ‘হাহাকার’কে অস্ত্র করেই কি তবে ট্র্যাডিশন ভেঙে কঙ্গুনাড়ু,তোন্ডাইনাড়ু, চোলানাড়ু এবং পান্ড্য নাড়ু (তামিল প্রদেশে আগে এ ভাবেই চারটি ভৌগলিক ভাগ ছিল)-তে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছে বিজেপি, কংগ্রেস— যারা এতদিন ব্রাত্য ছিল তামিল স্বাভিমানের কাছে?
(কী বললেন প্রধানমন্ত্রী, কী বলছে সংসদ- দেশের রাজধানীর খবর, রাজনীতির খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy