Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মেষপালিকা ভোটের বোড়ে-ই

শহরের মধ্যে এ রকম অসহযোগিতার আঁচ না পেলেও তা ক্রমশ প্রকাশ্যে এল বইকি। পরের দিন জম্মু-পঠানকোট হাইওয়ে ধরে কাঠুয়ার দিকে পনেরো বিশ কিলোমিটার এগোনোর পরই।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
কাঠুয়া (জম্মু) শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২৩
Share: Save:

এখানে শেষ বসন্তের রোদে এখনও যেন কিছুটা আবির লেগে রয়েছে!

অথচ শ্রীনগর থেকে নেমে গরমে ঝলসানোর কথাই মনে হয়েছিল। জম্মুর তাপমাত্রা, তা সে আবহাওয়ারই হোক বা ভোট অথবা নিরাপত্তার বজ্র আঁটুনি— প্রাথমিক ভাবে ভূস্বর্গের তুলনায় বেশ নমনীয় এবং ঢিলেঢালা। প্রথম দিন পৌঁছে রঘুনাথ মন্দির, বাজার হয়ে বিক্রম চৌক পর্যন্ত ঘুরে ফিরে তীর্থ পর্যটনের ঘনঘোর উন্মাদনা (মন্দিরের দু’শো গজের মধ্যেই প্রভূত রেস্তরাঁ, আমিষ-নিরামিষের কোনও বাছবিচার নেই এই হিন্দুপ্রধান শহুরে এলাকায়) দেখছি। আর মনে পড়ছে উপত্যকায় আসার পথে আলাপ হওয়া বিমান সহযাত্রী, এআইএফএফ-এর ম্যাচ রেফারি অরুণাভ ভট্টাচার্যের বলা কথাগুলো।

ভদ্রলোক আলাপ শুরু করেছিলেন এই বলে, “দেখছেন মশাই বাঙালি ঠাসা ফ্লাইট। সব যাবে কাটরা হয়ে বৈষ্ণোদেবী।” উনি ফুটবলের লোক জানার পর গল্প জমতে দেরি হয়নি! হোমওয়র্ক সেরে নেব বলে প্রশ্ন করাতে বললেন, পুলওয়ামার সময় উনি জম্মুতে ছিলেন। সন্তোষ ট্রফির ম্যাচ করাতে। “বৈষ্ণোদেবী স্পোর্টস কমপ্লক্সে সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা বুঝলেন। সবে পুলওয়ামা হয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কথা বলা বা সহযোগিতা বিলকুল বন্ধ।”

শহরের মধ্যে এ রকম অসহযোগিতার আঁচ না পেলেও তা ক্রমশ প্রকাশ্যে এল বইকি। পরের দিন জম্মু-পঠানকোট হাইওয়ে ধরে কাঠুয়ার দিকে পনেরো বিশ কিলোমিটার এগোনোর পরই। একটা ফ্ল্যাশ ব্যাকও হল। বছরখানেক আগে এসেছিলাম কাঠুয়ার মন্দিরে আট বছরের মেয়ের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ‘কভার’ করতে। সেবার মেরুকরণের ঝাঁজ সামাজিক স্তরে দেখেছিলাম প্রবল। আর এ বার দেখছি রাজনৈতিক প্রচারে।

হাইওয়ে থেকে পাথুরে রাস্তায় হিরানগর তহসিলে ঢোকার রাস্তার দু’ধারে উচ্চাবচ টিলা, পিপুল, বট, আকাশমণি আর কাঁটা ঝোপের জঙ্গল, মৌমাছি চাষের বিস্তর আয়োজন, সবকিছুই যেন থম মেরে রয়েছে। কাঠুয়া গণধর্ষণের জেরে (জম্মু পুলিশের চার্জশিট অনুসারে, গত বছর এপ্রিল মাসে এই গ্রামেরই পুরোহিত সঞ্ঝীরাম দিনের পর দিন মন্দিরে আটকে রেখে অত্যাচার করেছিল বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের বালিকা মেষপালিকাকে) তাঁবু গুটিয়ে যাযাবরেরা ফিরে গিয়েছিলেন হিন্দু সংখ্যাগুরু এই গ্রাম ছেড়ে। এ বার দেখছি তাঁরা ফিরে এসেছেন।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ফিরেই শুধু আসেননি, সেই নিহত মেষপালিকার (খুনের মামলা চলছে পঠানকোটের আদালতে) পরিবার বসবাস করছে নিজেদের বাড়িটিতেই। কেউ এখনও তাঁদের কিছু বলেনি। বলেনি তার কারণ, তাঁদের চোখের সামনে রাখলে রাখলে ভোটে লাভ। বিজেপি-তো রয়েছেই। কিন্তু শুধুমাত্র গত বছরের ওই ঘটনাকে সামনে রেখে এই এলাকায় দাপিয়ে বে়ড়াচ্ছে ইনসাফ চেয়ে গড়ে ওঠা একটি হিন্দুত্ববাদী দল— ডোগরা স্বাভিমান পার্টি। বিজেপি থেকে বেরিয়ে এসে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী চৌধরি লাল সিংহ যার নেতৃত্বে। যাঁদের বক্তব্য, মুসলমান যাযাবরেরা এসে এখানে জমি দখল করছে। এদের ইন্ধন জোগাচ্ছে পিডিপি-র মতো পার্টি। রাস্তায় বেশ কয়েক বার গাড়ি দাঁড় করাতে হল লাল সিংহের মিছিলের দাপটে।

গ্রামের রাস্তা থেকে কার্যত কুড়িয়ে গাড়িতে বসিয়েছি মেষপালিকার পালক পিতাকে। এক বছর আগের ঘটনা জানতে চাওয়ায় অস্থিসার ব্যক্তিটি বিড়বিড় করছেন। দেখি আমার নোটবুকে লেখা হচ্ছে, “ওর জিন আমাদের বাড়ির চারপাশে ঘোরে। বকরিরা মাঝেমাঝেই অস্থির হয়ে ওঠে রাতবিরেতে। ঘরের পাশে ছায়া সরে যায়।”

এতই নিরালা এবং নিস্তব্ধ ওই জঙ্গলে গ্রামের একপাশের জমিতে মেষপালিকার বাড়ি যে দিনের বেলাতেই গায়ে কাঁটা দেয়। দাওয়ায় বসে যা বলছিলেন পিতা, তাতে বেশ স্পষ্ট, ভোটে তাঁর পালিত কন্যা কোনও বিষয় হতে চলেছে কি না, তা নিয়ে তাঁর বা এখানে ছ’মাস বসত করা যাযাবরদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। ভোট রাজনীতি বা ভারতবর্ষ নিয়েও নেই। কাঠুয়া, বানিহাল, ডোডা, মারুয়া হয়ে কার্গিলে চলে যাওয়া গ্রীষ্মকালে। আবার শীতে ফিরে আসা উল্টো পথে এই উষ্ণ উপত্যকায়। এ টুকুই তাঁদের ভারতবর্ষের রুটম্যাপ।

তুলনায় অনেক তৎপর লাল সিংহের নেতৃত্বে জেগে ওঠা এই অঞ্চলের (জম্মুর দু’টি লোকসভা আসনের একটি কাঠুয়া) ব্যবসায়ী, পুজারী, শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী শ্রেণিভুক্ত হিন্দুরা। মেষপালিকার ওই জঙ্গলঘেরা ভুতুড়ে মহল্লা থেকে কাঁটাবন পেরিয়ে গ্রামের লোকালয়। যেখানে একটি পাকা বাড়িতে আছেন বিচারাধীন সঞ্ঝীরামের স্ত্রী। যিনি আমাকে সাংবাদিক বলে না বুঝে মুখ খুলছিলেন, “রাজপুত ...রা মুসলমানদের এখানে বসিয়েছে। নিজেদের বাচ্চাদের নিজেরা সামলে রাখতে পারে না। আমার স্বামীকে ফাঁসিয়েছে। পূজাআচ্চা নিয়ে থাকে সে, এমন কাজ করা সম্ভব? আদালত এর বিহিত করবে।” সাংবাদিক বোঝার পর অবশ্য ঝাঁটাপেটা করতে বাকি রাখলেন শুধু। “এই মিডিয়াই সর্বনাশের মূল। শুধু নোংরা ছড়াচ্ছে। এখান থেকে চলে যান। আমার কাছে সুবিধা হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Kathua Gangrape Case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE