Advertisement
০১ মে ২০২৪

নোট-কাণ্ডে বিরোধিতার রাশ ধরতে মমতার ফোন রাহুল-ইয়েচুরিকে

নোট-বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেই একজোট হয়ে লড়াই করার জন্য সব বিরোধী দলকে ডাক দিয়েছিলেন তিনি। এ বার নিজেই বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক সব শক্তিকে এক জায়গায় আনার চেষ্টায় নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নোটবিহীন রবিবারও। কলকাতার এটিএমগুলির একটি। ছবি: সুমন বল্লভ

নোটবিহীন রবিবারও। কলকাতার এটিএমগুলির একটি। ছবি: সুমন বল্লভ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৩
Share: Save:

নোট-বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেই একজোট হয়ে লড়াই করার জন্য সব বিরোধী দলকে ডাক দিয়েছিলেন তিনি। এ বার নিজেই বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক সব শক্তিকে এক জায়গায় আনার চেষ্টায় নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সাক্ষাতের সময় চাওয়া থেকে শুরু করে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী এবং সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে ফোন— সব রকম তাসই রবিবার টেবিলে ফেলেছেন তৃণমূল নেত্রী। যে প্রয়াসের মধ্যে একই সঙ্গে জোড়া কৌশল দেখতে পাচ্ছে রাজনৈতিক শিবির। নোট বদল ঘিরে মানুষের দুর্দশাকে ঘিরে মমতা যেমন এক দিকে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধিতার পরিসরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চাইছেন, তেমনই তাঁর রাজ্যে সিপিএমকে পরিণত করতে চাইছেন তৃণমূলের লেজুড়ে! যাতে জাতীয় থেকে রাজ্য— তৃণমূলই প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই ওই সিদ্ধান্তকে ‘তুঘলকি’ আখ্যা দিয়ে আসরে নেমেছিলেন মমতা। তার পরে যত সময় গিয়েছে এবং ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে বা বাজারে গিয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যত বেড়েছে, কেন্দ্র-বিরোধিতার সুরও তত চ়়ড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজে রাস্তায় বেরিয়ে এটিএম বা ব্যাঙ্কের বাইরে প্রতীক্ষারত মানুষের অভিজ্ঞতা শুনেছেন। মোদীর সরকার চরম গরিব-বিরোধী অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে বলে অভিযোগ করে রাজ্য রাজনীতিতে বরাবরের প্রতিপক্ষ সিপিএমের সমর্থনও চেয়েছেন একসঙ্গে ল়়ড়াইয়ের জন্য। শুধু আহ্বানেই না থেমে রবিবার তিনি নেমে পড়েছেন কাজেও।

তৃণমূল সূত্রের খবর, রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুকে ফোন করে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে এ দিন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন মমতা। রাষ্ট্রপতিকে তিনি জানান, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে মানুষের যে হয়রানি হচ্ছে, তার প্রতিকার চাইতে বিরোধী দলগুলির তরফে একটি প্রতিনিধিদল প্রণববাবুর হস্তক্ষেপ চায়। পরে রাষ্ট্রপতি ভবনের তরফে আগামী বুধবার দুপুরে সাক্ষাতের সময় দেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে মমতা বলেন, ‘‘রাষ্ট্রপতিকে ফোন করেছিলাম। ওঁকে অনেক ধন্যবাদ যে, নোট বাতিলের জেরে সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা তিনি ধৈর্য ধরে শুনেছেন। বিরোধীদের প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা করতে গেলে এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিশদে ওঁকে জানানো হবে।’’ সংসদে শীতকালীন অধিবেশনের গোড়াতেই নিজে উপস্থিত থেকে বিজেপি-র উপরে আরও চাপ বাড়ানোর জন্যই মমতা কাল, মঙ্গলবার দিল্লি যাচ্ছেন বলে তৃণমূল সূত্রের ইঙ্গিত।

রাষ্ট্রপতির কাছে দরবারের সময় ঠিক করে ফেলার পাশাপাশিই মমতা এ দিন যোগাযোগ করেছেন জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধী মঞ্চের সম্ভাব্য শরিক কংগ্রেস, আরজেডি, জেডিইউ, আম আদমি পার্টির মতো দলের সঙ্গে। কথা বলছেন রাহুলের সঙ্গে। রাহুল তাঁকে বলেছেন, তাঁরা কালো টাকা উদ্ধারের বিপক্ষে নন। কিন্তু মানুষের হয়রানির প্রতিবাদ করার জন্যই তিনি নিজে পথে নেমেছেন। মমতা তখন তাঁকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ভবনেও কংগ্রেসের যাওয়া উচিত বাকি বিরোধীদের সঙ্গে। তৃণমূল সূত্রের দাবি, রাহুল মমতাকে বলেছেন, গোটা বিষয়টি তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীকে অবহিত করবেন।

এমনকী, মমতা বাদ দেননি সিপিএমকেও। সটান ফোন করেছেন ইয়েচুরিকে! বলেছেন, মোদীর তুঘলকি কারবারের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন দরকার। তার জন্য একত্রে কৌশল ঠিক করে কেন্দ্রের উপরে চাপ বা়ড়াতে হবে। এই জন্যই রাষ্ট্রপতির কাছে সব বিরোধী দলের একসঙ্গে যাওয়া দরকার। ইয়েচুরিকে মমতা এ-ও জানান যে, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গেও কথা বলছেন। আরজেডি-র লালুপ্রসাদ বা আম আদমি পার্টির কেজরীবালের সঙ্গে একই বিষয়ে কথা বলেছেন মমতা।

ইয়েচুরি অবশ্য মমতাকে নির্দিষ্ট কোনও আশ্বাস দেননি। তৃণমূল নেত্রীকে তিনি শুধু বলেছেন, দিল্লি ফিরে আজ, সোমবার বাকিদের সঙ্গে কথা বলবেন। বাংলার সিপিএমের মতও নেবেন। আলিমুদ্দিন অবশ্য শনিবারই সারদা ও নারদা-যোগের প্রশ্ন তুলে তৃণমূলের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ও পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম এ দিনও সেই সুর বজায় রেখেছেন।

সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারকে চেপে ধরার জন্য কংগ্রেসের মতোই তৃণমূলও আগাম নোটিস দিয়ে রেখেছে নোট-প্রশ্নে আলোচনার। সংসদে অধিবেশনের আগে আজ, সোমবার দিল্লিতে বিভিন্ন দলের সংসদীয় নেতারা এমনিতেই বৈঠক করছেন। সেখানে এই নোট-প্রশ্নে স্বাভাবিক ভাবেই আরও আলোচনা হবে। কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ ওই বৈঠকে তৃণমূলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। তৃণমূলের তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডেরেক ও’ব্রায়েন দিল্লিতে থাকবেন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘সোমবারের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, কোন কোন দল সমবেত ভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে।’’

এনডিএ-র শরিক হওয়া সত্ত্বেও শিবসেনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদী। মমতার প্রস্তাব মেনে সরাসরি ইতিবাচক সাড়াই দিয়েছেন দিল্লির কেজরীবাল। তিনি এ দিন বলেছেন, মমতা নেতৃত্ব দিলে তাঁর সেখানে যোগ দিতে কোনও আপত্তি নেই। সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে কারও নেতৃত্ব কবুল করতেই তাঁর আপত্তি নেই। আপ সূত্রের মতে, এই মুহূর্তে সংসদে কেজরীবালের শক্তি নামমাত্র। ফলে, মমতার নেতৃত্বে দলভারী করতে তাঁদের কোনও অসুবিধা নেই। মমতার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও বিহারের নীতীশ কুমার অবশ্য নিজে এই জোটে যেতে চাননা। কারণ, এই বিষয়ে নীতীশ আগেই মোদীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। তবে বিজেপি-বিরোধিতার সুযোগ হাতছাড়া করতে না চেয়ে শরদ যাদবকে প্রতিনিধিদলে রাখতে পারে জেডিইউ।

মমতা অবশ্য কে এল এবং কে এল না— এই দৃষ্টিতে গোটা বিষয়টাকে দেখছেন না। তিনি বিজেপি-বিরোধিতার ঢাকে প্রথম কাঠি দিয়ে রাখতে চাইছেন। কেউ না এলেও যাতে বলা যায়, তিনি চেষ্টা করেছিলেন সকলকে এক জায়গায় আনার। কেউ না এলে সেটা তাদের সমস্যা। যে কারণে মমতা এ দিন বলেছেন, ‘‘এটা কোনও অহমিকার লড়াই নয়! আমি কেন্দ্রের কাছে আবার সবিনয় আবেদন জানাচ্ছি সাধারণ মানুষকে ভোগান্তি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য। যৌথ আন্দোলন এবং রাষ্ট্রপতির কাছে একসঙ্গে যাওয়ার জন্য আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সাধারণ, গরিব মানুষকে স্বস্তি দেওয়া এবং অর্থনৈতিক নৈরাজ্য বন্ধ করার লক্ষ্যে আমাদের সকলের একসঙ্গেই লড়া উচিত।’’

সক্রিয়তা বাড়িয়েই রাজনীতির চালে এক কদম এগিয়ে থাকলেন মমতা।

অভিষেক বার্তা

নিজস্ব সংবাদদাতা

নোট নিয়ে দেশ জুড়ে যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে সকলকে আহ্বান জানালেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘‘নবীন প্রজন্মের ভাইবোন-সহ সকলকেই অনুরোধ করছি, বৃদ্ধ-প্রতিবন্ধী-অন্তঃসত্ত্বা-শ্রমিক-কৃষক-মজুরদের সাহায্য করুন। যাঁরা লম্বা লাইনে দাঁড়াতে অসমর্থ বা ঠিকমতো ফর্ম ভরতে জানেন না, তাদের সাহায্য করুন। এটিএম আর ব্যাঙ্কের বাইরে খাবার জলের ব্যবস্থা রাখুন। জাতি-ধর্ম-রাজনৈতিক রং বিচার করবেন না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi Mamata Banerjee Sitaram Yechury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE