দশ ফুট বাই ছ’ফুটের ছোট্ট একটা ঘর। বৈঠকখানাও বলা যেতে পারে। গোটা ছয়েক চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া দেওয়ালে টাঙানো টিভি। আসবাব বলতে এই। টিভিতে ইংরেজি নিউজ চ্যানেল। নির্বাচনী ফল নিয়ে সেখানে তখন তুমুল তরজা। রাজনীতির সেই বিশ্লেষণ ঘেরা আলোচনাই মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন তিন-চার জন। দোতলা বাড়ির এক তলায় এই বৈঠকখানা। লাগোয়া ঘরের বাইরে ছোট্ট একটা হোর্ডিং। অম্বর ট্রেডার্স। সে ঘরের দরজা বন্ধ।
টিভির ঘরে আধা ঢোকা অবস্থায় জিজ্ঞেস করলাম, ভেতরে আসতে পারি?
প্রায় ভেতরে ঢুকে গিয়ে এমন প্রশ্নে অবাক হলেন না কেউই। মাঝের দিকে একটা চেয়ারে বসা মধ্য চল্লিশের এক ভদ্রলোক ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি দিলেন। তাঁকে জানানো গেল, কলকাতা থেকে নির্বাচন পরবর্তী বিহার দেখতেই এই মহল্লায় আসা। বসতে বললেন। নাম, পুরো পরিচয় জানার পর নিজের নাম জানালেন, ইকবাল আহমেদ আনসারি। অম্বর টেডার্সের মালিক তিনি। মূলত ইট-বালি-সিমেন্ট সরবরাহের কাজ করেন।
পটনা শহর থেকে কিলোমিটার দশেক দূরে ফুলওয়ারি। কাছাকাছির মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কী আছে জানতে চাওয়ায় এক সাংবাদিক বন্ধু এই ফুলওয়ারির সন্ধান দিয়েছিলেন। মূল শহরের প্রায় হাতায় থাকা ফুলওয়ারির গায়ে শহর সুলভ কোনও গন্ধ নেই। প্রধান রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে প্রথমে পিচ, পরে সিমেন্ট বাঁধানো পথ। দু’পাশে একাধিক মফসস্লীয় দোকানপাট। তেলেভাজা থেকে সব্জির ঠেলাগাড়ি সবই আছে সে পথে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবুজ রঙা আবিরও। বোঝা যায় এখনও নির্বাচনী রেশ কাটেনি ফুলওয়ারির।
রাস্তা থেকে টিভির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, এবং সেটা ইংরেজিতে। সে কারণেই ঢুকে পড়া গিয়েছিল ওই ঘরে।
কোনও রাখঢাক না রেখেই জিজ্ঞেস করলাম, বিজেপি-র কেন ভরাডুবি হল বিহারে? মুসলিম ভোট একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বাকিটা? বিহার এসে অবধি একটা জিনিস দেখেছি, যদি কাউকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা হয় কাকে ভোট দিলেন, তিনি নির্দ্বিধায় জবাব দেন। অন্তত যে জনা পঞ্চাশেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁদের ভেতর কোনও সঙ্কোচ দেখিনি।
ইকবালকেও যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ লাগল। বললেন, ‘‘বিজেপি-র মূল সমস্যা কি জানেন? ভোটের আগে সমাজকে ধর্মীয় মেরুকরণ করার একটা প্রবল চেষ্টা করে। সরকারে থেকে এমন অবিবেচকের মতো কাজ কী ভাবে করে একটা রাজনৈতিক দল বুঝতে পারি না। এমনকী, প্রধানমন্ত্রীও তার বাইরে বেরোতে পারলেন না!’’ কিন্তু, বিহারের মানুষ সেই মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করলেন কেন? ইকবালের মতে, রাজ্যের মানুষ লালুর সরকার দেখেছে। নীতীশের সরকার দেখেছে। দু’জনেই দু’জনের নিজস্ব ‘স্টাইল’-এ সরকার চালিয়েছেন। লালুর আমলে অনেক গণ্ডগোল ছিল। ‘জঙ্গল রাজ’ হিসেবে ‘খ্যাতি’ও পেয়েছে সেই সময়টা। নীতীশও খুব ভাল কাজ করেছেন বলে দাবি করছেন ইকবাল। স্কুল হয়েছে। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। বই, পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে ছাত্রীদের। লাল-হলুদ কার্ডে কম দামে চাল-গম দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক এলাকায় নলকূপ বসানো হয়েছে। রাস্তাঘাট খুব উন্নত হয়েছে। পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ সবকেই উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ধরেছে বিহারবাসী। বিহারের মানুষ আরও উন্নয়ন চেয়েছেন। বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার দৌলতে সেই উন্নয়নের কাজ করতে পারত, এটা কেউ কেউ ভেবেছিলেন। কিন্তু, মাঠে নেমে বিজেপি সেই উন্নয়নের পাশাপাশি ধর্মীয় মেরুকরণের কথা বলতে শুরু করে জোরালো ভাবে। আর সেই তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে পারেননি অনেকে।
ইকবালের মত তাঁর একার নয়। তাঁর বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে ফুলওয়ারির বাগ মহল্লায় যত জনের সঙ্গে কথা হয়েছে, প্রত্যেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন বিজেপি-র এই উন্নয়ন বনাম মেরুকরণের রাজনীতির কথা। ঠেলা চালিয়ে মহল্লায় সব্জি বিক্রি করেন আবদুল সাত্তার আনসারি। তিনি বললেন, ‘‘এমনটা বলা ঠিক হয়নি। জেতা-হারা তো রাজনীতিতে থাকবেই। তাই বলে এ ভাবে এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার খেলাটা খুব ‘খতরনক’ হতে পারে। বিজেপি নিজের ফাঁদেই নিজে জড়িয়ে পড়েছে।’’ মসু আলম, আবদা খাতুন, চাঁদনি পরভিন, শমিমা খাতুন, রসুল আহমেদ— সকলেরই এক রা। বিহারে এসে মোদী-অমিত ঠিক কথা বলেননি। আর সে কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল সোমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলির গলায়। তিনি বলেছেন, ‘‘কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের প্রভাব পড়েছে বিহারের ফলাফলে।’’
আর একটা কথা বলেছিলেন ইকবাল— ‘‘কে কী খাবে সেটা যদি কেউ এই সময়ে এসে ঠিক করে দেয়, তার থেকে মূর্খ এ দুনিয়ায় কমই আছে।’’ আর এর পরেই মোক্ষম প্রশ্নটি ছুড়লেন তিনি, ‘‘কী খাব সেটা যদি বিজেপি বা অন্য কেউ ঠিক করে দেয়, তা হলে আমরা কি আদৌ এ দেশে স্বাধীন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy