বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে বলে রিপোর্ট এসেছে সাউথ ব্লকের কাছে। বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সিন্ডিকেট, চাকরি বিক্রিতে জড়িয়ে পড়েছেন নেতা-কর্মীরা। এনসিপি-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্রিয় নেতার সংখ্যাও কমছে।
নয়াদিল্লি সূত্রের বক্তব্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে দলে জামায়াতের ছাত্র শিবিরের প্রভাব পড়েছে। ফলে দলে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। পরিস্থিতি এমন যে ২১৮ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েক জনকেই মাঠে নামতে দেখা যাচ্ছে। নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারি, হাসনাত আবদুল্লা ও সারজিস আলম প্রচারের আলোয় থাকলেও নিজেদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে। সামাজিক মাধ্যমে কে কখন কী বলছেন, তার সমন্বয় তো নেই-ই, জনগণের কাছে তাঁদের বার্তাও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ থাকছে না। এই বিরোধের কারণে এনসিপি-র জেলা বা উপজেলা কমিটি গড়ে ওঠেনি। অতিরিক্ত সামাজিক মাধ্যম নির্ভরতায় দলটির প্রকৃত সমর্থন কমছে বলে ওই সূত্রের দাবি।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় এনসিপি থাকলেও রাজনৈতিক দিশা বা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি এখনও জানানো হয়নি। তারা কারও সঙ্গে জোট করবে কি না সেটাও অজানা। জামায়াত এবং বিএনপি-র সঙ্গ নিয়ে দলের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। নাহিদ ইসলাম চাইছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ন্যাশনাল সিটিজেনস কমিটি (এনসিসি), এই দুই নামে তৃণমূল স্তরে পৌঁছতে। কিন্তু দু’টি সংগঠনই নির্বাচন কমিশনের নথিভুক্ত নয়। ফলে এই সূত্র কাজে আসেনি।
নয়াদিল্লির প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েও দলের মধ্যে বিরোধিতা রয়েছে। মনে করা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি, গণ অধিকার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্রচিন্তা, ইসলামি ছাত্র শিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র দল, ছাত্র লিগ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী-সহ বিভিন্ন দলের ‘খিচুড়ি’ হচ্ছে এনসিপি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় তৃণমূল স্তরের সঙ্গে ঢাকার নেতাদের সংযোগের অভাব স্পষ্ট। বামপন্থী, মৌলবাদী ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী ও ধর্মীয়গোষ্ঠীর লোক রয়েছেন এই দলে। কিন্তু সকলের গ্রহণযোগ্য আদর্শগত ভিত তৈরি হয়নি।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশি চেতনা নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পোস্ট এবং সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে দলটির ফেসবুক পোস্টে স্ববিরোধিতা রয়েছে। সমাজকর্মী তথা লেখক ফরহাদ মজহারের বক্তব্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মৌলবাদ নিয়ে এনসিপি-র বিরোধ যত প্রকট হচ্ছে, তত কমছে দলের গ্রহণযোগ্যতা। জুলাই-আগস্টের উচ্ছ্বাস অস্তমিত। জন্ম নিয়েছে শিক্ষার্থীদের অন্তত ৮০টি সংগঠন। সেই বিরোধের সূত্রে জুলাই ঐক্য ও জুলাই মঞ্চ নামে দু’টি সংগঠনও আত্মপ্রকাশ করেছে।
এনসিপি-র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারাই বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সমগ্র গণতান্ত্রিক উত্তরণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আমরা স্বল্পমেয়াদী হিসাব-নিকাশের জন্য এমন এক জাতির আশাকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে’। স্বার্থের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ় আলমের সঙ্গে এনসিপির সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। অথচ, কিছু দিন আগেও তাঁরা একসঙ্গে উপদেষ্টামণ্ডলীতে ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন। সূত্রের খবর, বহু বিশিষ্টজন গত বছর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করলেও এখন সামাজিক মাধ্যমে এনসিপির সমালোচনা করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সমাজমাধ্যমেই লিখেছেন, ‘ছাত্রশিবির বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছে।... ফ্যাসিবাদ বিরোধী অভ্যুত্থানের নামে জামায়াতের কাঁধে ভর করে এই ছাত্রনেতারা নব্য ফ্যাসিবাদের আমদানি করেনি তো?’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)