ছবি সংগৃহীত
গাঁধী তখন নেই। দেশ 'জাহান্নমে' যাচ্ছে বলে পরলোকচর্চার আড্ডায় মহাত্মাজিকে ডেকেই ব্যবসায়ী অবধবিহারী ঝটিতি রামরাজ্য পত্তনের 'সলাহ' চেয়েছিলেন। সেটা পরশুরামের গল্প রামরাজ্যর কথা!
বুধবারের অযোধ্যা-কাণ্ডেও রামমন্দিরের ভূমিপুজোর সঙ্গে রামরাজ্য ভাবনাকে মেলাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে গাঁধীর ‘রামরাজ্যে’র কথাই উঠে এসেছে।
মন্দিরে শ্রীরামচন্দ্র আছেন কি নেই তা পরের কথা! এই রামমন্দির নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে গাঁধীর রামরাজ্য ভাবনার আদর্শ যে কোথাও নেই, তা এক কথায় বলছেন ইতিহাসবিদেরা।
মোদী বলেছেন, এক অ-বিতর্কিত, সমদর্শী দীনদরিদ্রপ্রেমী রামচন্দ্রের কথা। তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের আদর্শের ভিত্তিতেই গাঁধী রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখেন বলে এ দিন প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেছেন।
তবে প্রবীণ ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘অসহযোগ আন্দোলনের সময়েই গাঁধীর মুখে প্রথম রামরাজ্যের কথা শোনা যায়। কিন্তু সেটা কী তা তখন খুঁটিয়ে ব্যাখ্যা করেননি।’’ আর এক ইতিহাসবিদ, সুগত বসুর মতেও, গাঁধীর রামরাজ্য প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ভরপুর। তাঁর কথায়, ‘‘গাঁধী তখন হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও সুশাসনের জন্য লড়ছেন। মোদী বা বিজেপির রামরাজ্য তো উপনিবেশ যুগের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সঙ্গে তুলনীয়। পুরোপুরি হিন্দু আধিপত্যবাদে ভরপুর।’’
রজতবাবুর মতেও গাঁধীর রামরাজ্যকে বুঝতে তাঁর রাষ্ট্রভাবনা সংক্রান্ত লেখালেখিকেই পড়তে হবে। ১৯০৯ সালে গুজরাতি ও ইংরেজিতে লেখা হিন্দ স্বরাজ এবং ১৯৪৭ নাগাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘দ্য স্পিচ অন দ্য ওশেনিক সার্কলে’ জোর দিচ্ছেন রজতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘গাঁধী গ্রাম পুনরুজ্জীবনের কথা বলছেন। তাতে উঁচুনিচু নেই। জাতিগত সংকীর্ণতা নেই। সহযোগিতা ও সহাবস্থানের পর পর বলয় মিলে এক ধরনের রাষ্ট্রহীন মানবসাগরের তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। যা মার্কস, এঙ্গেলসের থেকে আলাদা ধাঁচের এক আদিম সাম্যবাদ।’’
এটাই গাঁধীর রামরাজ্য হলে মোদী বা বিজেপিতে তার অস্তিত্ব কই, প্রশ্ন তুলছেন রজতবাবু। স্পষ্ট বলছেন, ‘‘এই রামমন্দির তো তৈরিই হচ্ছে নাগরিক সমাজের বড় অংশের দাবি নস্যাৎ করে। এ বছরই দেখা গিয়েছে, মোদী সরকার ছাত্রসমাজ, মুসলিম মহিলাসমাজের দাবি ধারাবাহিক ভাবে অস্বীকার করে চলেছে।’’ আর সুগতবাবুর মতে, গাঁধীর রামরাজ্য দূরে থাক, স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের স্বপ্নের ভারতের আদর্শটাই এই ঘেন্নার রাজনীতির যুগে মৃত। তা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
রামায়ণ বা রামকে অখণ্ড ঐক্যের সূত্র হিসেবে দেখাতে পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের ভাবনা চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেও একদেশদর্শিতা দেখেছে সারস্বত সমাজ। এ কে রামানুজন, রোমিলা থাপারেরা রামায়ণের একটি নির্দিষ্ট সূত্র বা বাল্মীকি-সর্বস্বতাকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। নবনীতা দেবসেনও রামায়ণকে ঘিরে নানা দৃষ্টিভঙ্গি মেলে ধরেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ঈপ্সিতা হালদারের কথায়, ‘‘সব রামায়ণে রাম মোটেই উচ্চকিত পৌরুষের প্রতীক নয়। দোষেগুণে মানুষ।’’ পরশুরামের গল্পে হনুমানও রামের শম্বুক হত্যা বা সীতাকে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। নিঃশর্ত ভাবে নায়ক হিসেবে রামকে মানেননি। আর রামকে অবতার বা নায়ক বলে মানলেও আজকের রামমন্দিরে ভক্তির থেকে রাজনীতির অভিসন্ধিটাই প্রবল বলে অনেকেরই অভিমত।
সুগতবাবুর মনে পড়ছে, ২০০৩এ সংসদে অযোধ্যা-বিতর্কে তাঁর মা কৃষ্ণা বসুর বক্তৃতার কথা। যিনি বলেছিলেন, এত হিংসা, বিদ্বেষের ভিত্তিতে গড়া মন্দিরে রামচন্দ্র কখনওই থাকতে পারেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy