বাজেট ঘোষণার সময়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ‘পরমাণু শক্তি মিশন’ গড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কূটনৈতিক শিবির মনে করেছিল, ওই ঘোষণার মাধ্যমে আসলে আমেরিকাকে ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এ বার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফরে সেই বার্তাই প্রায় অনুঘটকের কাজ করল। দুই দেশ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। ভারতে আরও বেশি পরমাণু চুল্লি তৈরি করবে আমেরিকা। এই বিষয়ে সহমত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং মোদী, দু’জনেই। প্রায় ১৬ বছর আগে দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি মেনেই এ দেশে আরও বেশি করে নিজেদের তৈরি এবং নকশা করা পরমাণু চুল্লি বসাবে আমেরিকা।
বৃহস্পতিবার ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠকে বসেন মোদী। সেখানেই দুই রাষ্ট্রনেতা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অসামরিক পারমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রে পরস্পরকে আরও বেশি সহায়তা করবে দুই দেশ। যৌথ বিবৃতি দিয়ে দুই দেশের তরফে জানানো হয়েছে, আমেরিকার নকশা করা পরমাণু চুল্লি ভারতে তৈরির বিষয়ে দুই দেশ সহমত হয়ে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ‘স্থানীয় প্রযুক্তি এবং সম্ভাব্য প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে’ এই কাজ হবে।
২০০৫ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সে সময় অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহযোগিতা করার বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে দুই দেশ। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে ২০০৮ সালে দুই দেশ চুক্তি করে। মনে করা হয়েছিল, তার পর ভারতে অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে আরও বেশি বিনিয়োগ করবে আমেরিকা। আরও বেশি সাহায্য দেবে। কিন্তু এ দেশের কড়া আইনের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। সেই আইনের অধীনে পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনা এবং তার দায়বদ্ধতা চুক্তির কারণে ১৬ বছর ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে অসামরিক পরমাণু ক্ষেত্রে কোনও কাজ অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। ওই চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিপাক্ষিক অসামরিক পরমাণু প্রকল্প শুরু হওয়ার বহু বছর পরেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তা হলেও বিনিয়োগকারী বিদেশি সংস্থা (এ ক্ষেত্রে আমেরিকান সংস্থা) ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। সেই কারণে পিছিয়ে যায় আমেরিকা।
১ ফেব্রুয়ারি বাজেট প্রস্তাব পড়ার সময়ে ভারতের এই পারমাণবিক শক্তি আইন এবং পারমাণবিক দায়বদ্ধতা আইন (সিএলএনডিএ) সংশোধনের কথা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা। এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে দুই পক্ষই। মোদী-ট্রাম্পের বৈঠকের পরে যৌথ বিবৃতি দিয়ে এমনটাই জানানো হয়েছে। তাতে আরও জানানো হয়েছে, সিএলএনডিএ মেনেই দুই দেশ পরস্পরকে সহায়তা করার কথা জানিয়েছে। ১৯৬২ সালের পারমাণবিক শক্তি আইনে বলা হয়েছে, পারমাণবিক শক্তি ক্ষেত্রে কোনও বেসরকারি সংস্থা বিনিয়োগ করতে পারবে না। মনে করা হচ্ছে, আইন সংশোধনের ফলে এই ধারারও বদল ঘটবে। আমেরিকার পারমাণবিক চুল্লি প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘জেনারেল ইলেক্ট্রিক’, ‘ওয়েস্টিংহাউস’ বহু বছর ধরেই এ দেশে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির বিষয়ে আগ্রহী। ‘ওয়েস্টিংহাউস’ সংস্থা এ দেশে এপি১০০০ পরমাণু চুল্লি বিক্রি নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনাও সেরেছে সাউথ ব্লকের সঙ্গে। অন্ধ্রপ্রদেশের কোভ্ভাড়ায় ১,০০০ মেগাওয়াটের পরমাণু চুল্লি বসানোর বিষয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন:
গত কয়েক বছরে ছোট মাপের চুল্লি (স্মলার মডিউলার রিঅ্যাক্টর) তৈরি নিয়ে আমেরিকার আরও কিছু সংস্থা এবং ফ্রান্সের সংস্থার সঙ্গেও কথাবার্তা হয়েছে সাউথ ব্লকের। বৃহস্পতিবার আমেরিকার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়ালট্জের সঙ্গে এই নিয়ে মোদীর কথা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। এ বার এ দেশের আইন সংশোধন হলে এই আলোচনা কার্যকর হবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে দূষণ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুতের ক্ষেত্রেই কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ প্রায় শূন্য। সে কারণে বহু দেশ এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান একে মোহান্তি একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে এ দেশে ১০০ গিগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে দেশে। যদিও এই শক্তি উৎপাদনে জ্বালানির জোগান সীমিত। সে কারণে বেসরকারি সংস্থাগুলি ছোট চুল্লি বসানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এ বার সেই পথই প্রসারিত হতে চলেছে। এ দেশে আরও বেশি পরমাণু চুল্লি বসাবে আমেরিকা।