Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পাহাড়-জঙ্গলে লুকিয়ে লোকায়ত কথা

একটা গোটা বছর দেখতে দেখতে কেমন অতীত হয়ে গেল। জীবন থেকে খসে পড়ছে এক একটা দিন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তির মত বলতে ইচ্ছে হয়, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’ কত কিছু দেখার আছে, কত কিছু করার আছে, কত কিছু শেখার আছে, কতটুকুই বা হবে এই এক জীবনে? তবু মানুষের জন্য কিছু করে যেতে ইচ্ছে হয়।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩১
Share: Save:

একটা গোটা বছর দেখতে দেখতে কেমন অতীত হয়ে গেল। জীবন থেকে খসে পড়ছে এক একটা দিন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তির মত বলতে ইচ্ছে হয়, ‘জীবন এত ছোট কেনে?’ কত কিছু দেখার আছে, কত কিছু করার আছে, কত কিছু শেখার আছে, কতটুকুই বা হবে এই এক জীবনে? তবু মানুষের জন্য কিছু করে যেতে ইচ্ছে হয়। আমারই দেশের কত মানুষ এখনও অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আছে; তাদের কাছে পৌঁছে দিতে ইচ্ছে করে আলোর ঠিকানা।

মনে আছে সুধীজন, আপনাদের শুনিয়েছিলাম পুরুলিয়ার কথা। পুরুলিয়ার পাহাড় জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা তার লোকসম্পদের লোকায়ত কথা। আজ আবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি আমার ডালি, যার মধ্যে থেকে আরো কিছু লোকশিল্পের কারুকৃৎ ছড়িয়ে দেবো আপনাদের মধ্যে। পুরুলিয়ার আদি ঠিকানা যে মানভূম – মানভূম না গানভূম তা বোঝা দায়। রুখুশুখু, হতদরিদ্র এই জেলা তার সকল অবহেলাকে নীরবে সহ্য করেও ফল্গুধারার মত বুকের ভেতর বইয়ে দিয়েছে নাচ ও গানের এক অনিঃশেষ প্রবাহ। শত দারিদ্রের মধ্যেও বাজনা বেজে উঠছে, ‘দিদির দাং দিদির দাং দিদির দাং’......গান ধরছেন মূল গায়েন, ‘দাড়া হাড়া অড়া দুয়ার তালা রে। লিগির লিগির গেঞ হারাঞ’......অমনি মাথায় পাতা, হাতে ফুল, পায়ে বালা, হলুদ ছোপা লাল পেড়ে আদিবাসী মেয়েরা হাতে হাত জড়িয়ে, এগোতে এগোতে, পেছোতে পেছোতে নেচে চলেছে......বাজনার তালে তালে, গানের সুরে সুরে। জীবনের এক অদ্ভূত উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে এই নাচগানের মধ্যে। এখানে সবকিছু এত উন্মুক্ত – কোথাও কোনও আড়াল নেই – জীবন যেন এখানে তার সব ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে ধরা দেয় এক সীমাহীন সারল্যে।

পুরুলিয়ার শ্রেষ্ঠ নাচ ‘ছৌ-নাচ’। ছৌ নাচ দেখা যায় বিহার ও ওড়িশার অনেক স্থানে এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের কোনও কোনও গ্রামে। এই নাচে দরকার হয় না কোনও মঞ্চের। বৃত্তের আকারে দাঁড়ান জনতা। বৃত্তের মধ্যেই থাকে বাজনদারেরা। একপাশে থাকেন গায়েনরা। নাচিয়েরা মুখে পরেন মুখোশ। পালা অনুসারে মুখোশ ও পোশাক তৈরি হয়। ‘শিব-দুর্গা’ পালায় শিব, দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং ওই সব দেবদেবীর বাহনদের মুখোশ। এ ছাড়া দেবদেবীদের হাতে থাকে ত্রিশূল, সাপ, বীণা ইত্যাদি। ‘মহিষাসুরবধ’ পালায় থাকে দুর্গার দশ হাত, দশ হাতে অস্ত্র, দুর্গা ও মহিষাসুরের মুখোশ। পশু-পাখি চরিত্রেরও মুখোশ আছে। রামায়ণ, মহাভারত কিংবা কোন পুরাণ কাহিনীতে তৈরি করা হয় চরিত্রানুযায়ী চমৎকার সব মুখোশ। সত্যি কথা বলতে কী পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ তৈরি একটি অপূর্ব শিল্প বটে। ছৌ-নাচ আরম্ভ হয় সাধারণত রাত দশটার পরেই। আরম্ভের আগে খুব জোরে বাজনা বাজতে থাকে। প্রচণ্ড জোরে বাজনা বেজে একসময় থেমে যায় তারপর বন্দনা শুরু হয় – বন্দনাশেষে শুরু হয় নাচ। গানে গানে কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে নাচও চলতে থাকে। পুরুলিয়ায় এই নাচ চলে সাধারণত চৈত্র থেকে জৈষ্ঠ পর্যন্ত টানা তিন মাস। এ নাচ বাঁচিয়ে রেখেছেন মূলত কুর্মি, মাহাতো ও ভূমিজরা। এই নাচে পুরুষরাই কুশীলব। নানা ভঙ্গির অঙ্গচালনা রয়েছে, খুব পরিশ্রমসাধ্য – একসঙ্গে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি করা যায় না। তবু দর্শককে খুশি করতে হয়, যারা রাতভর বসে থাকেন।

বর্তমানে ছৌ নৃত্যের চারটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়। ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের ছৌ-নাচ, ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেলার ছৌ-নৃত্য, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ এবং ঝাড়গ্রামের চিলকিগড়ের একটি ধারা। যুদ্ধনৃত্য থেকেই এর উদ্ভব। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের বিশেষত্ব তার মুখোশের ব্যবহার। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান ড: আশুতোষ ভট্টাচার্য পুরুলিয়ায় আসেন এবং পুরুলিয়ার নাচের দলগুলি থেকে গড়া হল নতুন দল ‘ফরেন’ অর্থাৎ বিদেশ যাওয়ার জন্যে। ছৌ নাচে একটা বড় পরিবর্তন হল। প্রেক্ষাগৃহের উপযোগী করে তৈরি করা হল ছৌ নাচের দলকে। একটার বেশি নাগড়া আর ঢোল বাজানো বন্ধ হল, কুশীলবদের গোল হয়ে ঘোরাও বন্ধ হল। মঞ্চে মুখ ফেরাতে হল একদিকেই। ছৌনাচের নিবিড় জীবনবোধ, বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস ক্রমশ ফিকে হয়ে এল। তবে জীবনের গতি তো এমনই বিচিত্র, তা কি কখনও এক জায়গায় থেমে থাকে? ছৌনাচের দলের প্রথম পাড়ি লণ্ডন। তারপর প্যারিস, নিউইয়র্ক, শিকাগো, লস এঞ্জেলস। প্রাচ্যে সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, চীন, জাপান, কোরিয়া। বিশ্বের সর্বত্র মানুষের হৃদয় জয় করে নিল এই ছৌ-নাচ।

ছৌ নাচ ছাড়াও পুরুলিয়ার লোকগানের অমূল্যসম্পদ ঝুমুর গান। এই অঞ্চলের নিজস্ব একান্ত ঐতিহ্য ঝুমুর গান। ঝুমুর গানের আদি পর্যায়ে এর তাল মাত্রা সেভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল না। মাঠে কৃষক রমণী বা গ্রাম্য যুবকদের কন্ঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গীত হত এই গান। কবিগীত, উধয়া, টাঁড় ঝুমুর প্রভৃতি প্রথম পর্যায়ের ঝুমুরের উদাহরণ। এই ঝুমুরে কোন ভনিতা থাকত না। পরিশীলিত বোধের অভাবে এই পর্যায়ের ঝুমুর গান অনেক সময় শ্লীলতার বাঁধন মানত না। ধীরে ধীরে ঝুমুর গানের বিকাশ ঘটে নাচনি নাচকে ঘিরে। পুরুলিয়ার জঙ্গল সর্দাররা নাচনি নাচে মাতিয়ে রাখতেন তাদের দরবার। ঝুমুরের কিংবদন্তী পুরুষ ভবপ্রীতানন্দ ওঝা কাশীপুর রাজদরবারের সভাকবি ছিলেন। তিনি ঝুমুর গানে নাচনিদের অবদান স্বীকার করে গেছেন। ঝুমুরের বিকাশে পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডির জমিদারদেরও অবদান ছিল। পরবর্তীকালে কবিরা ঝুমুর রচনায় এগিয়ে এলে ঝুমুর গানে ক্রমশঃ ভণিতার প্রয়োগ হতে শুরু করে। প্রথম যুগের ভণিতাহীন ঝুমুরের সুর ও উচ্চাঙ্গের রাগরাগিণীর মিশ্রণে দরবারী ঝুমুরের ধারা তৈরি হয়েছে। অনেক প্রকারের ঝুমুরকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করতে পারা যায়- বৈঠকি ঝুমুর, নাচশালার ঝুমুর ও ডাঁড়শালের ঝুমুর। বৈঠকি ঝুমুরে নাচ চলে না, নাচ হলেও তা বিরল। নাচশালার ঝুমুর সাধারণত নাচনি নাচের সময় বা ছৌ নাচের সময় প্রয়োগ করা হয়। ‘মাদল’ ঝুমুর গান ও নাচনি নাচের অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র। ডাঁড়শালের ঝুমুর ভাদ্রমাসে হয়। এজন্য একে ভাদুরিয়া ঝুমুরও বলা হয়ে থাকে। ভাদুরিয়া ঝুমুরে বেঁচে আছে লৌকিক ঝুমুর।

সুধীজন, নিশ্চই আপনারা মনে মনে ভাবছেন, আহা, এমন মাটির গন্ধমাখা গান আর নাচের আবেশে বিভোর হওয়া বুঝি আর হল না! এই সুদুর মুম্বইয়ে কোথায় পাওয়া যাবে সেই সুদূর পুরুলিয়ার ছৌ নাচ, ঝুমুর গান বা সাঁওতালি নাচ?

সুধীজন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির ডালি নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হচ্ছে ‘লালমাটি উৎসব ও গান মেলা’। জানুয়ারির ২২, ২৩ এবং ২৪ তারিখ তিন দিনব্যাপী এই উৎসবে আপনারা পাবেন মাটির স্পর্শ। আপনাদের জন্য জানিয়ে দিই অনুষ্ঠান-সূচী।

নভি মুম্বইয়ের সিবিডি বেলাপুরের আর্বান হাটে অনুষ্ঠিত হবে এই অনুষ্ঠান। ২২শে জানুয়ারি সন্ধে ছটায় পদ্মশ্রী শেখর সেন লালমাটি উৎসবের উদ্বোধন করবেন। এরপর থাকবে সাঁওতালী নৃত্য। পরের অনুষ্ঠান গীতি-আলেখ্য ‘পুরুলিয়ার পাঁচালী’, পুণের একটি সংস্থা ‘উপাসনা’র তত্ত্বাবধানে। পরিচালনায় শর্মিলা মজুমদার। এরপর রয়েছে বাউলগান, শিল্পী কার্তিকদাস বাউল। সবশেষে রয়েছে দুটি নাটক। এম এস ডি এস এসের পরিচালনায় ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ এবং রূপাঙ্গনের পরিচালনায় ‘তিন বান্দর’। ২৩শে জানুয়ারি সকাল আটটায় শুরু হয়ে যাবে অনুষ্ঠান। প্রথমেই পদ্মশ্রী শেখর সেনের ভক্তিমূলক গান। এরপর রয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। দুপুরে থাকবে ছৌ নাচের ওয়ার্কশপ। আবার বিকেল চারটে থেকে আরম্ভ হয়ে যাবে অনুষ্ঠান। সাঁওতালী গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু। এরপর দীপক রায়ের গীটার বাদন। যন্ত্রসঙ্গীতের পর ‘পূবালী’র ব্যালেনৃত্য। এরপর অনিন্দ্য-শেলীর গানের অনুষ্ঠান। গানের পর একটি অভিনব অনুষ্ঠান, ‘ফ্যাশন শো’। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতিকে শাড়িতে ফুটিয়ে তুলে এই অভিনব আয়োজন ‘নকশা’র শান্তনু গুহঠাকুরতার পরিচালনায়। র‌্যাম্পে হাঁটার ছন্দ মিলে যাবে ভাস্কর রায়ের গাওয়া ঝুমুর গানের সঙ্গে। এরপর বনি চক্রবর্তী লাইভ। সবশেষে ছৌ-নাচ।

২৪শে জানুয়ারি শেষ দিন সকাল আটটায় ধ্রুপদী যন্ত্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। তারপর শান্তিনিকেতন আশ্রমিক এ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠান ‘মাঠের বাঁশি’। উৎসব প্রাঙ্গনে থাকবে বাউলের আখড়া। বাউল গান গাইবেন সংঘমিত্রা দাস। দুপুরে ‘মুভি টাইম’। লোকসংস্কৃতির ওপর তথ্যচিত্র। বিকেল চারটেয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আড্ডা। সন্ধে ছটা থেকে শুরু ‘মূর্চ্ছনা কয়ার’ এর গানের অনুষ্ঠান। পরিচালনায় বিশিষ্ট সঙ্গীতায়োজক পীযূষ ধর। গানের পর আবৃত্তি। লালমাটির কবিতা শোনাবেন চন্দ্রিমা রায়। এরপর আশীর্বাদ মাহাতোর কন্ঠে দরবারী ঝুমুর। ঝুমুর গানের পর বংশীবাদন – পণ্ডিত রুনু মজুমদার। এরপর রয়েছে ‘আরাত্রিকা’র নৃত্যানুষ্ঠান – ‘আমাদের এই বসুন্ধরা’।

‘লালমাটি উৎসব’ এর অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানিয়ে দিলাম। তবে বেলাপুরের আর্বান হাটের অ্যাম্ফিথিয়েটারে এইসব অনুষ্ঠান ছাড়াও থাকবে ফটো এগজিবিশন, লাইভ পেন্টিং, ছৌ-নাচের মুখোশ তৈরি, পটচিত্র, ঘাসের তৈরি নানা সামগ্রী, মাদুর, পুরুলিয়ার মেয়েদের হস্তশিল্প প্রভৃতি। আর থাকছে রসনার তৃপ্তির জন্য বাঙালি খাবারের স্টল ‘খাইবার পাস’।

তা হলে সুধীজন, আপনারা নিশ্চই চলে আসবেন ‘লালমাটি উৎসবে’ মাটির টানে – ‘মা’টির স্পর্শ নিতে!

‘লালমাটি উৎসব ও গান মেলা’র আয়োজক সংস্থা রঞ্জিৎ ঝর্ণা কাঁসাই ইকো ফাউণ্ডেশন এবং এই সংস্থা পুরুলিয়ার অনগ্রসর মানুষদের উন্নতিকল্পে কাজ করে চলেছে। সংস্থার কর্ণধার রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায় তাঁর লক্ষ্যে উপনীত হোন ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনাই করি।

নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন

সম্প্রতি মুম্বইয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, মুম্বই শাখার এক দিবসীয় সম্মেলন মালাডের দুর্গাদেবী সরাফ ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট স্টাডিস এর কনফারেন্স হলে ২০শে ডিসেম্বর।

অনুষ্ঠান শুরু হয় উদ্বোধনী সঙ্গীত ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ গানটি দিয়ে। উপস্থিত সকলেই গলা মেলান। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, মুম্বই শাখার সভাপতি ডঃ পি এস কুণ্ডু স্বাগত ভাষণ দেওয়ার পর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমে প্রধান অতিথি মিলন মুখোপাধ্যায়কে বরণ এবং সম্মান প্রদর্শন করা হয়। মিলন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুধীজন আপনাদের পরিচয় তাঁর লেখার মাধ্যমে। এই ‘মুম্বই’ পাতায় তিনি নিয়মিত লিখে থাকেন। এই বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটু বলে নিই। প্রায় অর্ধ শতক আগে উনিশশো তেষট্টির ঊনত্রিশে জুন মিলন মুখোপাধ্যায় মুম্বই আসেন। লোকে লোকারণ্য ভিটি স্টেশন কিন্তু তাঁর পরিচিত মুখ একটিও নেই – নেই মায়ের ভাষার একটিও শব্দ। আর্ট কলেজের শিক্ষাশেষে ভাগ্য অন্বেষণে মুম্বই পাড়ি। জুটেও গেল কাজ, বিজ্ঞাপন কোম্পানীতে। কিন্তু ধরাবাঁধা চাকরিতে কি আর সৃজনশীলতার মূল্য পাওয়া যায়? পোষাল না ঐ বাঁধা চাকরির একঘেয়েমি। অভিনয়েও উৎসাহ ছিল তাঁর বরাবর। সে সুবাদে সিনেমা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু এবং আলাপ পরিচয় তাবড় তাবড় নায়ক নায়িকাদের সঙ্গে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ঘরে ঢোকার আমন্ত্রণ লেখালেখির সূত্র ধরেই। জন্ম হল ‘আনন্দলোক’ এর ‘বোম্বাই বাতচিৎ’ এর ‘বাবুমশাই’ এর। এদিকে টাইমস অফ ইণ্ডিয়াতেও ফ্রিল্যান্স চলছে। পুরোপুরি স্বাধীনভাবে ঐ অফিসে ঢুকে যাওয়া সত্তর এর দশকে। ১৯৭০ সালে বম্বেতে প্রথম একক প্রদর্শনী তাজমহল আর্ট গ্যালারীতে। শৈশববিহীন শিশুরা। পেলেন স্ক্যাণ্ডেনেভিয়ান স্কলারশিপ। ফ্রান্সে গেলেন ছবি আঁকা ও প্যারিসে একক প্রদর্শনীর জন্য। পাড়ি দিলেন ইউরোপ। প্রথমে ইটালির রোম ও তারপর প্যারিস ১৯৭১ সালে। একক প্রদর্শনী হল প্যারিসে, স্টকহোমে। চষে ফেললেন ইউরোপ। আর এই অভিজ্ঞতাই রূপ পেল ‘দেশ’ এর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত উপন্যাস ‘মুখ চাই মুখ’-এ। লেখা চলল আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়, সানন্দা, আনন্দলোক, পরিবর্তন, প্রতিদিন ইত্যাদি পত্রপত্রিকায়। আমন্ত্রিত হয়েছেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। অষ্ট্রেলিয়া থেকে ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য বা আরবরাজ্যে ঘুরতে হয়েছে নানা ছবির একক প্রদর্শনী নিয়ে। এটাই ভাবার যে এত দেশ বিদেশ ঘুরে, প্রায় পাঁচ দশক বহির্বঙ্গে অতিবাহিত করেও আজও তিনি বাংলা ভাষা মায়ের ভাষার চর্চা করে যাচ্ছেন।

মিলন মুখোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জ্ঞাপনের পর শুরু হয় আলোচনা সভা। মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির পূর্ব পর্যন্ত কথা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়। এই পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘মুম্বই শহরে বাংলা ভাষার সেবা’, ‘মারাঠি ও বাংলা সাহিত্যের পারস্পরিক মেলামেশা’, ‘মুম্বই শহরে বাংলা ভাষা শিক্ষা এবং প্রসার’ এবং ‘নাট্য সাহিত্যে মারাঠি ও বাংলা ভাষার আদান প্রদান’। বক্তা ছিলেন যথাক্রমে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মিঃ পি কে গুহ, লেখক ও মারাঠি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদক জগৎ দেবনাথ, মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন এবং বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব লাকি মুখার্জী। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। এই পর্বে বক্তাদের বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য এবং সঞ্চালনা করেন দেবেশ গঙ্গোপাধ্যায়। মধ্যাহ্নভোজনের পর শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। কাব্যসাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা। বিষয় ছিল ‘কাব্যসাহিত্যে বাংলা ও মারাঠি ভাষার পারস্পরিক স্থান’ এবং ‘বাংলা কাব্য সাহিত্যের বর্তমান ধারা’। ‘বাংলা কাব্যসাহিত্যের বর্তমান ধারা’ সম্পর্কে বক্তা লেখিকা শবরী রায় চমৎকার আলোচনা করেন। এই পর্বের সঞ্চালনায় ছিলেন অমল রায়। এরপর স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান জয়ন্তী দাসগুপ্ত, অর্ঘ্য দত্ত, উমা মৈত্র, মলি দত্ত, চিত্রা মিত্র, স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, বাবলু গিরি এবং জগৎ দেবনাথ। পরবর্তী পর্যায়ে ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং রজনীকান্ত সেনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। সঙ্গীতে অংশগ্রহণ করেছেন রুমা চট্টোপাধ্যায়, অভিজিৎ চক্রবর্তী, স্বরূপা চক্রবর্তী, সুরজিৎ নন্দী এবং মহুয়া বসু। সমগ্র অনুষ্ঠান অত্যন্ত মনোজ্ঞ হয়ে ওঠে এবং দর্শক শ্রোতারা তা উপভোগ করেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, মুম্বই শাখার সহ সভাপতি গোরা চক্রবর্তী। সংস্থার সভাপতি প্রশান্ত শেখর কুণ্ডু, সহ সভাপতি গোরা চক্রবর্তী, কর্মসচিব শংকর মৈত্র, কোষাধ্যক্ষ শ্যামাপ্রসাদ রায় এবং অন্যান্য সদস্যদের সাধুবাদ জানাই মুম্বই শহরে বাংলা ভাষার প্রসার ও চর্চার এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।

আজ তবে এইটুকু থাক। আজ আসি। আবার আপনাদের কাছে ফিরে আসব নতুন কোন অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে।

ঋণস্বীকার: অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, সম্পাদনা দেবপ্রসাদ জানা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

purulia paromita mukherjee paromita mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE