ভারত-চিন যুদ্ধে মাও জে দংকে ঠেকাতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। আকাশপথে ‘রেড আর্মি’র মোকাবিলা করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছে সেনা-অস্ত্র-বিমান চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। ‘জেএফকে’স ফরগটেন ক্রাইসিস: টিবেট, দ্য সিআইএ অ্যান্ড দ্য সাইনো-ইন্ডিয়ান ওয়ার’ বইটিতে এমনটাই দাবি করেছেন প্রাক্তন সিআইএ আধিকারিক ব্রুস রিডেল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার কথা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
গত কাল মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিঙ্গস ইনস্টিটিউটে বইটির প্রিভিউ অনুষ্ঠানে লেখক নিজেই নেহরুর চিঠির কথা জানান। পাশাপাশি রিডেল দাবি করেছেন, নেহরুকে ‘অপদস্থ’ করতেই ১৯৬২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন মাও জে দং। কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় নেতা হিসেবে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন নেহরু।
তাঁর আরও দাবি, মাওয়ের পাখির চোখ নেহরু হলেও সার্বিক ভাবে ভারতের হার যে চিনের দুই ‘শত্রু’ আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর চাপ তৈরি করবে তা ভালই বুঝেছিলেন মাও। ১৯৬২ সালের ৬ অক্টোবর বেজিংয়ে সেনা আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন মাও। পড়শি দেশে ‘নৃশংস ও যন্ত্রণাদায়ক’ হামলা চালাতে রেড আর্মিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলেও বইয়ে দাবি করেছেন রিডেল। চিনের এই উগ্র আক্রমণে ভারতের বহু এলাকা হাতছাড়া হয়ে যায়। বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। সেই সময়েই কেনেডিকে চিঠি লিখে পাশে দাঁড়ানোর আর্জি জানান নেহরু। তিনি চিঠিতে এ-ও জানিয়েছিলেন, যুদ্ধে আমেরিকা ছাড়াও অন্য বন্ধু-রাষ্ট্রের সাহায্য চায় ভারত। রিডেলের বইয়ে দাবি করা হয়েছে, ওই পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের কাছেও সাহায্য চাইতে পিছপা হননি নেহরু।
রিডেলের দাবি, প্রথম চিঠিটি পাঠানোর পরপরই কেনেডিকে ফের চিঠি লেখেন ‘কোণঠাসা’ নেহরু। ১৯৬২ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সেই চিঠি হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দেন আমেরিকায় নিযুক্ত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বি কে নেহরু। চিনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’র আক্রমণে ‘দিশাহারা’ নেহরু সেই চিঠিতে আকাশপথে চিনের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে সক্রিয় হওয়ার আর্জি জানান।
কেনেডির কাছে কী কী চেয়েছিলেন নেহরু?
প্রিভিউ অনুষ্ঠানে নেহরুর চিঠি উদ্ধৃত করে রিডেল বলেন, ‘‘ন্যূনতম ১২ স্কোয়াড্রন সুপারসনিক, যে কোনও আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে এমন পাইলট। আধুনিক রেডার কভার ভারতে নেই। তাই প্রাথমিক ভাবে মার্কিন বায়ুসেনা আধিকারিককেই সেনা ও বিমানের দায়িত্ব নিতে হবে। অন্তত যত ক্ষণ না আমাদের সেনা প্রশিক্ষিত হচ্ছে।’’
এখানেই শেষ নয়, রিডেলের বই বলছে, ভারতের পাশে দাঁড়াতে যুদ্ধের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে আমেরিকা পদক্ষেপ করার আগেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দেন মাও জে দং। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সেই সময় যুদ্ধে এগিয়ে ছিল চিনই। গোটা উত্তর-পূর্ব তো বটেই, এমনকী, কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে বিরতি টানে চিন। রিডেলের বিশ্লেষণ, ওই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন আর আমেরিকা যে ভারতের পাশে দাঁড়াতে পারে সেই আশঙ্কাতেই যুদ্ধে ইতি টানেন মাও।
রিডেলের মতে, সেই সময় দিল্লির ‘নড়বড়ে’ অবস্থানের ফায়দা তোলার মতো অবস্থায় ছিল ইসলামাবাদও। তবে কেনেডির হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তে পাক-আক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়। এই বিশাল সংখ্যক মার্কিন সেনা যে শুধু চিনকে প্রতিরোধ করতেই ব্যবহৃত হবে তা চিঠিতে নিশ্চিত করেছিলেন নেহরু।
রিডেলের কথায়, ‘‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন আমেরিকার বোমারু বিমান কোনও পরিস্থিতিতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে না ভারত।’’ ভারতের উপর চিনের এই ভয়াবহ আক্রমণকে যে কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করে নেহরু লেখেন, ‘‘এটা শুধু ভারতের প্রশ্ন নয়। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন!’’ সেই প্রেক্ষিতে চিনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করা তিব্বতের পাশে দাঁড়াতেও আমেরিকার কাছে বি-৪৭ বোমারু বিমান চেয়েছিলেন নেহরু।
অনুষ্ঠান শেষে রিডেলের সহাস্য মন্তব্য, ‘‘ওই সময় আমেরিকা চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলে কী হতো, কে জানে! হয়তো বর্তমান কূটনৈতিক দৃশ্যপটটা পাল্টে যেতে পারত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy