Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
নির্ভয়া-তথ্যচিত্র

কেন দেখানো বন্ধ, ভয় কীসের, প্রশ্ন বাবার

এই তথ্যচিত্র একটা আয়না। যে আয়না বলে দেয়, আমাদের মন কতটা বিকৃত। কিন্তু আমরা ক’জন এই আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে চাই? নির্ভয়াকে নিয়ে লেসলি উডউইনের তথ্যচিত্রের সম্প্রচার কেন ভারতে নিষিদ্ধ করা হল, সেই প্রশ্ন তুলে এই মন্তব্য করেছেন নির্ভয়ার বাবা বদ্রীনাথ সিংহ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “এই তথ্যচিত্র মানুষের রাগ আরও উস্কে দেবে, বিক্ষোভ দেখাতে লোকজন আবার পথে নামবে। সেই ভয়েই কি এটা দেখানো নিষিদ্ধ করল সরকার?”

নির্ভয়ার মা আশা ও বাবা বদ্রীনাথ সিংহ।

নির্ভয়ার মা আশা ও বাবা বদ্রীনাথ সিংহ।

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩০
Share: Save:

এই তথ্যচিত্র একটা আয়না। যে আয়না বলে দেয়, আমাদের মন কতটা বিকৃত। কিন্তু আমরা ক’জন এই আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে চাই?

নির্ভয়াকে নিয়ে লেসলি উডউইনের তথ্যচিত্রের সম্প্রচার কেন ভারতে নিষিদ্ধ করা হল, সেই প্রশ্ন তুলে এই মন্তব্য করেছেন নির্ভয়ার বাবা বদ্রীনাথ সিংহ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “এই তথ্যচিত্র মানুষের রাগ আরও উস্কে দেবে, বিক্ষোভ দেখাতে লোকজন আবার পথে নামবে। সেই ভয়েই কি এটা দেখানো নিষিদ্ধ করল সরকার?”

ভারত সরকারের আইনি নোটিসে কান না দিয়ে বুধবার রাতে এখানকার একটি চ্যানেলে তথ্যচিত্রটি সম্প্রচার করে বিবিসি। তার পর সেটি ইউটিউবেও দিয়ে দেয়। ফলে গোটা বিশ্বের মাউসের নাগালে চলে আসে ‘ইন্ডিয়াজ ডটার’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে ইউটিউব থেকে তথ্যচিত্রটি সরিয়ে নিলেও বিভিন্ন লিঙ্ক থেকে সেটি মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে একটি ভারতীয় বেসরকারি ইংরেজি টিভি চ্যানেলে তথ্যচিত্রটি দেখানোর কথা ছিল। নিষেধাজ্ঞা জারি না হলে হয়তো তথ্যচিত্রটি সম্পর্কে সাধারণ ভারতীয় দর্শক বিশেষ খোঁজ-খবরই রাখতেন না। কিন্তু রাজনীতিকদের ‘গেল গেল’ রব তথ্যচিত্রটিকে অনেক বেশি প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ, যাঁদের একটা বড় অংশ ভারতীয়, এই তথ্যচিত্র দেখে ফেলেছেন বলে মত ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞদের।

এই তথ্যচিত্র আমাদের সকলের দেখা উচিত, বলছেন বদ্রীনাথ। কেন? মেয়ে হারানো বাবার জবাব, “মেনে নেওয়া ভাল যে আমাদের সমাজে ভাল আর খারাপ, দু’ধরনের মানুষই রয়েছে। আসল ঘটনাটা পাঁক ঘেঁটে বার করে এনেছে এই তথ্যচিত্র।” ভারতে সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অনুরোধ করেছেন পরিচালক। সেই মোদী, যিনি গত বছর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় বলেছিলেন, “প্রতিটি ধর্ষকই তো কারও ছেলে। খারাপ পথে হাঁটার আগে মা-বাবারই উচিত তাকে থামিয়ে দেওয়া।” প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্য বদ্রীনাথের মনে আছে কি না, কে জানে! তিনি শুধু প্রশ্ন তুলছেন, “কোনটা খারাপ, সেটা যদি আমাদের ছেলেদের না বোঝাতে পারি, তা হলে আমাদের মেয়েদের বাঁচাব কী করে!”

ধর্ষক মুকেশ সিংহের সাক্ষাৎকারটি নির্ভয়ার পরিবারকে দেখিয়েছিলেন পরিচালক। যে সাক্ষাৎকারে মুকেশ বলেছে, “মেয়েটা আমাদের বাধা দিতে গিয়েছিল বলেই ওকে মরতে হয়েছে। চুপচাপ থাকলে আমরা ‘কাজ সেরে’ ওকে ফেলে রেখে চলে যেতাম। আমাদের যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা হলে এর পর কেউ ধর্ষণ করলে মেয়েটাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে!” নির্বিকার মুখে সে বর্ণনা করছে, কী ভাবে নির্ভয়ার জামাকাপড়, তার বন্ধুর জ্যাকেট ‘ট্রফি’ হিসেবে রেখে দিয়েছিল ধর্ষক-খুনিরা। “শুধু ওর দেহের ভেতর থেকে ছিঁড়ে আনা নাড়িভুঁড়ি নিয়ে কী করব বুঝতে পারিনি। একটা প্যাকেটে ভরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলেছিলাম সেগুলো।” কী মনে হয়েছিল এই কথাগুলো শুনে? বদ্রীনাথের জবাব, “দুঃখ হয়েছিল, খুব। কিন্তু রাগ হয়নি। মুকেশ তো জেলে বসে সমাজের গায়ে থুতু ছিটিয়ে যাচ্ছে। কেন যে ওকে ফাঁসি দিতে এত দেরি করা হচ্ছে, জানি না!” বদ্রীনাথ এ-ও মনে করেন, “মুকেশ তো একা নয়। বহু পুরুষ মানুষ, বহু শিক্ষিত পুরুষ মানুষের মনের কথাটাই ও বলে দিয়েছে।”

তথ্যচিত্রে মুকেশের দুই আইনজীবীর বক্তব্য শুনলেই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে যায়, মুকেশ একা নয়। আইনজীবী এ পি সিংহ যেমন আগেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার মেয়ে বা বোন যদি বিয়ের আগে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে তাকে আমার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব আত্মীয়স্বজনের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেব।” তথ্যচিত্রে এই প্রসঙ্গে ফের একই কথা বলেন তিনি। আর এক আইনজীবী এম এল শর্মার দাবি, “মেয়েরা ফুলের মতো। তাদের মন্দিরে রেখে পুজো করতে হয়। সমাজে তাদের কোনও জায়গা নেই।” এই শর্মাই ২০১৩ সালে ধর্ষকদের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে বলেছিলেন, “ধর্ষণ করতে গেলে এক জন পুরুষকে উত্তেজিত হতে হয়। কিন্তু উত্তেজনাটা আসে কোথা থেকে? চারপাশে মেয়েরাই তো উত্তেজনার রসদ জোগায়, তবেই না...?” প্রসঙ্গত, এই ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করার জন্য এই দুই আইনজীবীর বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে নিয়ে আলোচনা করতে শুক্রবার এক বৈঠক করেছে ভারতীয় বার কাউন্সিল।

এই ধরনের মানসিকতা থেকেই তো ধর্ষণ বা সম্মান রক্ষার্থে খুনের ঘটনায় ভরে যায় রোজকার খবরের কাগজ, মনে করেন দিল্লির সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের অধ্যক্ষ রঞ্জনা কুমারী। ব্রিটেনের অনাবাসী ভারতীয়রাও বলছেন, এই তথ্যচিত্র সকলের দেখা উচিত। লেবার পার্টির সাংসদ সীমা মলহোত্রের কথায়, “সেই ভয়াবহ রাত আর ধর্ষকের সাক্ষাৎকার ছাড়াও এই তথ্যচিত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এর প্রতিবাদে সারা দেশ কী ভাবে লড়াই করল, সেটাই তুলে ধরেছেন উডউইন।” নির্ভয়া-কাণ্ডের প্রতিবাদ ভারতবর্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ, মত সীমার। প্রতিবাদটাই তথ্যচিত্রের মূল বিষয়বস্তু, ধর্ষণের ঘটনাটি বা ধর্ষক মুকেশ নয়, বলেছেন পরিচালক নিজেই। “সেই প্রতিবাদকে জিইয়ে রাখতেই তথ্যচিত্রটি ভারতবর্ষে দেখানো উচিত,” বলেন সীমা। ভারতেও এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদী স্বর শোনা গিয়েছে। পরিচালক অনুরাগ বসু বলেছেন, “এই তথ্যচিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা মানে উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে বসে থাকা।” অভিনেতা বোমান ইরানির স্বীকারোক্তি, “ছবিটা দেখতে দেখতে আমাদের ভয়ঙ্কর অস্বস্তি হবে, রাগ হবে, ধর্ষকটাকে ধরে মারতে ইচ্ছে করবে। আর তাই জন্যই এটা দেখা উচিত।” নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার দিনই টুইটারে জম্মু-কাশ্মীরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা লিখেছিলেন, “তথ্যচিত্রটি নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কী আছে? সারা দেশ জুড়ে এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, মেয়েদের এত অপমান সহ্য করতে হচ্ছে, বরং সে সবের জন্যই লজ্জা পাওয়া উচিত।”

বদ্রীনাথ জানান, ছেলেমেয়েদের সমান ভাবে বড় করেছিলেন তাঁরা। “ছোট থেকেই বলতাম, পড়াশোনা করো। লেখাপড়া করে তোমাদের ভাল চাকরি করতে হবে। তা হলেই গরিবি ঘুচবে।” গর্বিত গলায় তিনি বলেন, “আমার মেয়ে তার ভাইদের কাছে আদর্শ ছিল। ওকে বড় করেছিলাম, এক জন ভাল মানুষ, ভাল নাগরিক হবে এই আশা নিয়ে। সেই লক্ষ্যে আমি আর আমার স্ত্রী সফল হয়েছি। মৃত্যুর পরেও আমাদের মেয়ে অনেকের কাছে আদর্শ। মেয়েকে নিয়ে আমরা গর্বিত।”

নির্ভয়া মারা যাওয়ার পরে রাস্তাঘাটে যে মেয়েকেই দেখেন, নিজেদের মেয়ে বলে মনে হয় বদ্রীনাথ-দম্পতির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirbhoya shrabani basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE