ঝড়ের পরে তছনছ গোপীনাথপুর গ্রাম। ইনসেটে দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র।
তত দিনে ফণীর ঝাপটের পরে দশ দিন কেটে গিয়েছে। ভুবনেশ্বর থেকে পুরী জেলার প্রত্যন্ত সব গ্রামে পৌঁছনো তখনও সোজা ছিল না।
সাক্ষীগোপালের কাছে জল, বিদ্যুতের বেহাল পরিকাঠামোয় ক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদে আমাদের সফর এক দিন বাতিল করতে হল। পরের দিন ব্রহ্মগিরি ব্লকের চেনা গ্রামে ঢুকতেই পরিচিত মহিলার সঙ্গে দেখা। দু’দশক আগের ‘সুপার সাইক্লোন’-এর সময় থেকে এই সব গ্রামে আসছি। এর পরে স্থানীয় পরিবেশ রক্ষায় ‘চিলিকা আন্দোলন’-এ জড়িয়ে পড়েও ওই তল্লাটে বার বার এসেছি। ব্রহ্মগিরি ব্লকের সাহজানপুর গ্রামের মীনা বারিক আমায় চিনতে পেরে কাঁদতে-কাঁদতে জড়িয়ে ধরলেন।
ফণীর ধাক্কায় জীবনহানি এড়াতে পারার জন্য ওড়িশা সরকারের ঢালাও প্রশংসা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেই প্রশংসা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গত চার দশকে নানা দুর্বিপাক চাক্ষুষ করে বলতে পারি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে জীবনের ছন্দ ফেরানোর তৎপরতায় এখনও পিছিয়ে আমরা। এ বছর তো আবার ভোট-বিধির নানা ঝকমারিও ছিল!
ওড়িশায় একটি জায়গা বাদে লোকসভা-বিধানসভা ভোটপর্ব মিটে গিয়েছিল ফণী আসার আগেই। তবু গোটা দেশ তো তখনও ভোটপুজো নিয়েই মেতে। পুরী জেলার প্রান্তিক গ্রামের কী হাল, তাতে আর কী আসে-যায়! সাহজানপুরে মীনার ঘর বলতে কিছু নেই। পলিথিনের একটা ছাউনির নীচে গুটিকয়েক হাঁড়িকুড়ি পড়ে। ওই সময়ে কলকাতায় এক পুরনো বন্ধুকে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটি ছবি পাঠিয়ে যা বলেছিলাম, সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করব! বিপর্যয়ের এমন চেহারা দেখলে আমাদের জানলার একটা কাচ ভাঙলে বা হঠাৎ লোডশেডিং হলে হা-হুতাশের জন্য লজ্জাই করে।
সাহজানপুরে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উপড়ে পড়া গাছের গুঁড়ি, ধ্বস্ত মাটির বাড়ির ছড়াছড়ি। পর্যটক ভরপুর চিলিকা হ্রদের সাতপাড়ার কাছেই যেতে হয়েছিল। ব্রহ্মগিরি ও কৃষ্ণপ্রসাদ ব্লকের ১২টা পঞ্চায়েত এলাকা। ৫৮টা গ্রামের ৯২০০ পরিবারের অবস্থাটা আমরা জরিপ করছিলাম। সমুদ্রসৈকতের কাছে আরাখাকুডা গ্রাম। এই সব এলাকা কাজু গাছের জন্য বিখ্যাত। এক-একটি কাজু গাছ পাঁচ বছরে পুরোপুরি বেড়ে ওঠে। কাজু চাষের পুরো ক্ষেত্রটাই তছনছ হয়ে গিয়েছে। লোকে প্রাণে বাঁচলেও এলাকার অর্থনীতি অন্তত ২৫ বছর পিছিয়ে গিয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত।
গ্রামে-গ্রামে ঘুরে আমরা ক্ষয়-ক্ষতির হিসেব করছিলাম। এখনও বিকল্প জীবিকার রাস্তা অবশ্য ঠাহর করতে পারছি না। কিন্তু বেশির ভাগ গৃহহারা গ্রামবাসীই কোনও স্কুলবাড়ি বা প্রশাসনিক ভবনে থাকছে। খাওয়াদাওয়া হয়তো বিধায়কদের দাক্ষিণ্যে ‘কমিউনিটি কিচেনে’! মজার ব্যাপার, সাহজানপুর, গোপীনাথপুরের মতো গ্রামে দেখতাম, এই দুঃসময়েও মেয়ে-বৌরা শ্বশুর-ভাসুরদের সামনে বসে খেতে অপারগ। তাঁদের খাবারটা মাথা গোঁজার অস্থায়ী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হত।
বিপন্নদের জন্য পরিবারপিছু ৫০ কেজি চাল, ২০০০ টাকা বরাদ্দ করেছে ওড়িশা সরকার। তা মোটামুটি পৌঁছেও গিয়েছে। কিন্তু গোটা পরিস্থিতি জরিপ করার কাজ, ভোট গণনার পরে সবে শুরু করেছে প্রশাসন। আমরা আপাতত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সবার ঘর গড়ে দেওয়া, এবং ঝড়ের হাওয়াতেও মজবুত সৌর আলো বসানোর পরিকল্পনা করেছি। ডাইরিয়া-জন্ডিসে কাবুদের চিকিৎসাও চলছে।
দুর্যোগের মোলাকাত সব সময়ই কিছু আশ্চর্য শিক্ষা দেয়। তামিলনাডুর তরুণ স্থপতি মদন জয়রাজের কথা কী করে ভুলি! নাগাপট্টনাম থেকে মোটরবাইক চালিয়ে এসে তিনি আমাদের টিমে যোগ দিলেন। মদনের পরিকল্পনামাফিকই, গৃহহারাদের বাড়ি হচ্ছে। টালি বা মাটির বদলে, বাঁশ-কাঠ-টিনের বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেই বাড়ির নকশা নিজে করে দিয়েছেন মদন। বাইরের ঘর, রান্নাঘর, শোওয়ারঘর এবং দোতলার বারান্দা— সব থাকছে ২৭০ বর্গফুটের মধ্যে। মদনের দলবল কয়েক দিনের মধ্যেই যোগ দেবে বাড়ি তৈরিতে। আমিও ওড়িশায় ফিরে এসেছি।
গোপীনাথপুরের স্কুলবাড়িতে এ বার দেখলাম, বিপদের সময়ে পাশাপাশি মিশে গিয়েছে হিন্দু ও মুসলিম পরিবার। দেশ জুড়ে তখনও ভোটের আগে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগির খেলা চলছে। প্রকৃতির তাণ্ডবের সামনে আমাদের রাজনীতির মারপ্যাঁচ নিতান্তই অসার মনে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy