নিছক দুর্ঘটনা নয়। খড়্গপুর, পুরী-সহ দেশের ছ’-সাতটি জায়গায় বিভিন্ন ট্রেনে সম্প্রতি আগুন লাগার পিছনে পাক গুপ্তচর সংস্থার হাত দেখছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর তাঁদের দাবি, আইএসআই মোটা টাকা দিয়ে একদল লোক ঠিক করেছিল, যারা প্রতিটি ক্ষেত্রে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করেছে। সেই সব কুশীলব ও আড়কাঠিদের খুঁজে বার করে গোটা ষড়যন্ত্র সামনে আনতে এই তদন্তভার জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-কে দিতে চলেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
সন্ত্রাস ও নাশকতার ঘটনার তদন্তে ও দমনে এনআইএ-কে বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী সংস্থা বলে গণ্য করা হয়।
এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তা শনিবার বলেন, ‘‘এখনও লিখিত নির্দেশ না এলেও ঘরোয়া ভাবে বলা হয়েছে, আমাদেরই ওই তদন্ত করতে হবে। আমরা প্রাথমিক খোঁজখবর ইতিমধ্যে নিয়েছি, কিছুটা এগিয়েছি।’’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লিখিত নির্দেশ আসার পর মামলা রুজু করবে এনআইএ। ট্রেনে আগুন লাগার সাম্প্রতিক সব ঘটনাকে একসঙ্গে এনে একটিই মামলা রুজু করে তদন্ত হবে বলে জানান ওই অফিসার।
গত ১২ নভেম্বর বিকেলে পুরী স্টেশনে নন্দনকানন এক্সপ্রেস, তিরুপতি এক্সপ্রেস ও পুরী-হাওড়া এক্সপ্রেস— এই তিনটি ট্রেনের মোট পাঁচটি কামরা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ট্রেন সেই সময়ে খালি থাকায় কেউ হতাহত হননি।
তার কয়েক ঘণ্টা আগে, ওই দিন দুপুরে ভুবনেশ্বর স্টেশনে দিল্লি-পুরী নন্দনকানন এক্সপ্রেসে, প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত, দ্বিতীয় শ্রেণির একটি স্লিপার কোচে আগুন লাগে। ওই বগিতে তখন পাঁচ জন প্রতিবন্ধী ছিলেন। আগুন ধরার কিছু ক্ষণের মধ্যেই চালকের নজরে পড়ে যাওয়ায় বড় বিপদ এড়ানো গিয়েছে বলে রেলপুলিশের তদন্তে বেরোয়। ইঞ্জিনের পরেই ছিল কামরা।
আবার ওই দিনই সকাল পৌনে ৮টা নাগাদ খড়্গপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি খালি ট্রেনের বগিতে আগুন লাগে।
এনআইএ-র ওই শীর্ষকর্তা বলেন, ‘‘নিছক কাকতালীয় বলে মনে হচ্ছে না। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই এই ব্যাপারে এগোনো হয়েছিল। না হলে এই ভাবে একই পদ্ধতিতে বিভিন্ন জায়গায় কী ভাবে আগুন লাগবে?’’ তিনি জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মৌখিক ভাবে বলার পরেই পুরী, ভুবনেশ্বর ও খড়্গপুরে এনআইএ-র গোয়েন্দারা গিয়েছেন। গোয়েন্দাদের আরও দু’টি দল যাচ্ছে গয়া ও হরিদ্বারে। তবে পুরীতে তিনটি ট্রেনের পাঁচটি কামরায় আগুন লাগার পরেই এনআইএ-র একটি দল সেখানে গিয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্রের খবর, ভারতে কাজ করা পাক মদতে পুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রায় সবারই কোমর এক রকম ভেঙে গিয়েছে। এই অবস্থায় আইএসআই সরাসরি টাকা দিয়ে লোক লাগিয়ে কাজটা করেছে বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি। এই ব্যাপারে মুম্বইয়ের বাসিন্দা একদল যুবকের খোঁজ চলছে। বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে, গুলি না চালিয়েও অন্য ভাবে প্রাণহানির লক্ষ্যে ট্রেনে আগুন লাগানো হয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ।
১২ নভেম্বর, ঘটনার দিনই পুরী স্টেশন থেকে সুভাষ রামচন্দ্রন নামে এক সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়। সুভাষকে প্রাথমিক ভাবে জেরা করে ওড়িশা পুলিশ ও রেলের মনে হয়েছে, ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পিছনে বড়সড় ষড়যন্ত্র আছে।
ওড়িশায় এ দিন সুভাষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এনআইএ।
রেল এবং রেলপুলিশের দাবি, সব ক’টি ঘটনায় একই পদ্ধতিতে আগুন লাগানো হয়েছে এবং দুর্ঘটনা তো নয়ই, বদমায়েশি বললেও এর গুরুত্বকে খাটো করা হবে। এটা পরিষ্কার নাশকতা, যার উদ্দেশ্য ছিল বিপুল সংখ্যায় প্রাণহানি, কোনও একটা ভুলের জন্য সেটা হয়নি। কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনেরই হাত আছে বলে দাবি ওড়িশা পুলিশের। তাদের পক্ষ থেকেই খোদ ডিজি কানোয়ার ব্রিজেশ সিংহ এনআইএ তদন্ত চেয়ে শুক্রবার বিবৃতি দেন।
শুধু ওড়িশা বা সেই রাজ্যের নিকটবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের খড়্গপুরে নয়, গত ৪ নভেম্বর বিকেলে হরিদ্বার স্টেশনে হৃষীকেশ-দিল্লি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের একটি বগিতে আগুন ধরে যায়। ওই ঘটনাতেও অবশ্য কেউ হতাহত হননি। গয়া স্টেশনও এই মাসের গোড়ায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে বাদ যায়নি।
আবার ১ নভেম্বর অন্ধ্রপ্রদেশের পার্বতীপুরম স্টেশনের কাছে কয়লাবোঝাই মালগাড়িতে আগুন লাগে। মালগাড়িটি ওড়িশা থেকে যাচ্ছিল বিশাখাপত্তনমে। ওই ঘটনার কিছু দিন আগে, ২১ অক্টোবর তামিলনাড়ুর পেরুনগুড়ি স্টেশনের কাছে একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে আগুন ধরে যায়।
ওই সব ঘটনাও এনআইএ খতিয়ে দেখবে।