ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজ়েশকিয়ানকে উত্তেজনা সংযত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এক সপ্তাহ আগে ইজ়রায়েলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে সংঘাত যে দিকে এগোচ্ছে তাতে দু’তরফের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়াকে নিয়মিত অভ্যাস করে নিতে হবে নয়াদিল্লিকে। জাতীয় স্বার্থের জন্য ভারতের কাছে তা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেও সরু দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছিল নয়াদিল্লিকে। সে কাজটি যথেষ্ট পারদর্শিতার সঙ্গেই করে এসেছে মোদী সরকার। কিন্তু ইজ়রায়েল এবং ইরানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা এতটাই তুল্যমূল্য যে ভারসাম্য রাখতে হবে আরও নিক্তিতে মেপে। এই যুদ্ধ যদি অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলতে থাকে, তা হলে সম্ভবত এটিই নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর বাহিনীর কাছে ভারসাম্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জে ইজ়রায়েলের হামলা-বিরোধী প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল নয়াদিল্লি। প্রশ্ন উঠেছিল ইজ়রায়েলের দিকে ঝোঁকা নিয়ে। তারপরই এই যুদ্ধের পরিস্থিতিতে বিশেষ সৌজন্য দেখিয়ে তেহরান ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপদে ফেরার জন্য আকাশপথ খুলে দেয়। ঠিক তারপর আমেরিকা ইরানের পরমাণু শক্তিকেন্দ্রগুলিতে বোমা বর্ষণ করে।
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, ইরানের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক এবং সভ্যতাগত সম্পর্ক গভীরে প্রোথিত। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইজ়রায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা ক্রমশ নিবিড় হয়েছে। ইরান যখন ক্রমশই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে, ভারতের পক্ষে একটি বিশেষ দিক নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ‘সংলাপ এবং কূটনীতির’ মন্ত্র আওড়ে যেতে হচ্ছে।
ইরানের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লা আলি খামেনেই বার কয়েক কাশ্মীর প্রশ্নে (সংখ্যালঘু নির্যাতন) ভারতের সমালোচনা করলেও ইরান কখনও নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া এই দেশের কৌশলগত অবস্থান ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে দেশের চাবাহার প্রকল্পও নয়াদিল্লির কাছে পাখির চোখ। আমেরিকার এত দিনের ইরান সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাও এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে খাটো করতে পারেনি। পাকিস্তানকে এড়িয়ে চাবাহারের মধ্যে দিয়ে মধ্য এশিয়ার বিকল্প পথের জন্যই শুধু নয়, চাবাহার ভারতের কাছে চিনের ‘ওবর’ মহাযোগাযোগ প্রকল্পের পাল্টা অস্ত্রও বটে। আন্তর্জাতিক উত্তর–দক্ষিণ পরিবহণ করিডর গড়ার জন্য চাবাহার উন্নয়নের দশ বছরের চুক্তি সই করেছে নয়াদিল্লি। উদ্দেশ্য, ইউরোপেদ্রুত পৌঁছনো।
ইজ়রায়েলের সঙ্গে মোদী সরকারের সখ্যও বারবারই সামনে চলে এসেছে বিভিন্ন বহুপাক্ষিক প্রেক্ষাপটে। গাজ়ার নিরীহ মানুষের উপর ইজ়রায়েলের হামলায় এসসিও-র নেওয়া প্রস্তাবেও ভারত ভোট দেয়নি। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ইজ়রায়েলের অস্ত্র সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ভারত। আবার ভারতের অস্ত্র সংস্থাও ইজ়রায়েলকে বিস্ফোরক এবং ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করে থাকে, গাজ়ার যুদ্ধে যা দেখা গিয়েছে। কৃষি প্রযুক্তি ও জলসম্পদের ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলের উপর ভারতের নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে।
সব মিলিয়ে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে সুস্পষ্ট একতরফা অবস্থান নেওয়া নয়াদিল্লির পক্ষে কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)