দিন কুড়ি আগের ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টে গরমের ছুটি। শুধু অবকাশকালীন বেঞ্চ বসছে। কিন্তু শীর্ষ আদালতের সামনে রণক্ষেত্রের চেহারা। বিচারপতিদের এজলাসের সামনে মস্ত থাম দিয়ে ঘেরা করিডর গত বছর কাচের দেওয়াল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, যাতে আইনজীবীদের এজলাস থেকে বেরিয়েও গরমের মধ্যে দাঁড়াতে না হয়। কিন্তু তাতে আদালত ভবনের সামনের চেহারাটাই বদলে গিয়েছিল। গরমের ছুটির সময় দেখা গেল, কাচের দেওয়াল, বাতানুকূল যন্ত্র খুলে ফেলা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের তেমনই নির্দেশ। সুপ্রিম কোর্ট ফিরছে পুরনো চেহারায়।
কেন এই ভোলবদল? আইনজীবীদের অভিযোগ, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের জমানায় কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই এই সব বদল হয়েছিল। সে জমানায় সুপ্রিম কোর্টের বহু পুরনো লোগোও বদলে নতুন নীল রঙের লোগো তৈরি হয়েছিল। সেই লোগো বসেছিল কাচের দেওয়াল থেকে আদালতের পোর্টালে। তা-ও মুছে গিয়ে আবার পুরনো লোগো ফিরেছে। সে জমানায় মাসের দু’টি শনিবার শীর্ষ আদালতের অফিস ও রেজিস্ট্রিতে ছুটি ঘোষিত হয়েছিল। বর্তমান প্রধান বিচারপতির নির্দেশে আবার মাসের চারটি শনিবারই রেজিস্ট্রি ও অফিস আগের মতো খোলা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত জারি হয়েছে।
আইনজীবীদের একাংশ বলছেন, প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন চন্দ্রচূড়ের জমানার চিহ্ন একে একে মুছে ফেলা হচ্ছে। প্রথমে বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত। তার পরে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক দফতর থেকে কেন্দ্রীয় আবাস ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে চিঠি গিয়েছে, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের সরকারি বাংলো খালি করানো হোক। অবসরের পরে আট মাস কেটে গেলেও তিনি বাংলো আটকে রেখেছেন।
আইনজীবীরা বলছেন, এই চিঠি চন্দ্রচূড়-জমানার যাবতীয় চিহ্ন মোছার কর্মসূচিরই অঙ্গ। এক প্রবীণ আইনজীবী বলেন, ‘‘বর্তমান প্রধান বিচারপতির সবুজ সঙ্কেত না থাকলে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে বাংলো থেকে উৎখাত করার দুঃসাহস কি সুপ্রিম কোর্টের কোনও অফিসার দেখাতে পারতেন!’’
ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পরে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন সঞ্জীব খন্না। তিনি প্রথমেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে চন্দ্রচূড়ের সব থেকে বিতর্কিত রায়টি বদলে দিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন চন্দ্রচূড় বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদে সমীক্ষার অনুমতিতে বাধা দেননি। ফলে সম্ভলের জামা মসজিদ থেকে অজমেঢ় শরিফের নীচে মন্দির রয়েছে বলে দাবি ওঠে। বিভিন্ন আদালত মসজিদে সমীক্ষার অনুমতি দিতে শুরু করে। প্রধান বিচারপতি হয়েই সঞ্জীব খন্না রায় দেন, কোনও আদালত মসজিদে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিতে পারবে না। উপাসনাস্থলের চরিত্র বদলের দাবি নিয়ে মামলাও করাযাবে না।
আইনজীবীদের মতে, চন্দ্রচূড়-জমানায় গোটা সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। ধারণা তৈরি হয়েছিল, তিনিই সব। জুনের শেষে এক বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি গাভাই বলেছেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে উদয় উমেশ ললিত, সঞ্জীব খন্না ও আমি এই ধারণা দূর করার চেষ্টা করেছি যে, সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতির আদালত।’’ আইনজীবীরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রধান বিচারপতি গাভাই ‘সযত্নে’ বিচারপতি ললিত ও বিচারপতি খন্নার মাঝে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নামবাদ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এ বার প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন চন্দ্রচূড় তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের লাইব্রেরির মধ্যে জাতীয় বিচারবিভাগীয় জাদুঘর তৈরি করিয়েছিলেন। ‘হাই সিকিউরিটি জ়োন’-এ জাদুঘর তৈরির ফলে সেখানে আমজনতা ঢুকতে পারছে না। এ দিকে আইনজীবীদের জায়গার অভাব হচ্ছে। বার অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, এই জাদুঘর বাইরে সরানো হোক। শীর্ষ আদালতের আধিকারিকরা মনে করছেন, যে ভাবে একের পর এক চন্দ্রচূড়-চিহ্ন মোছা হচ্ছে, তাতে জাদুঘর সরানোও সময়ের অপেক্ষা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)