Advertisement
E-Paper

পড়ুয়াদের দাবিকে সমর্থন! বাঙালি অধ্যাপককে বহিষ্কার করল দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়

এ বিষয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক স্নেহাশিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। বহিষ্কারের খবরটি তিনি নিশ্চিত করেছেন। যদিও এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:১১
বাঙালি অধ্যাপক স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে বহিষ্কার করল দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়।

বাঙালি অধ্যাপক স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে বহিষ্কার করল দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

পড়ুয়াদের আন্দোলনে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে আগেই তাঁকে সাসপেন্ড করেছিল দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় দু’বছর ধরে সাসপেনশনে থাকা সেই বাঙালি অধ্যাপক স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে এ বার বহিষ্কারও করলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আনন্দবাজার ডট কম-কে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, নিয়ম মেনেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে। ঘটনাচক্রে, স্নেহাশিসের সাসপেনশনের বিষয়টি দিল্লি হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে বিচারাধীন। তার মধ্যেই বহিষ্কৃত কলকাতার স্নেহাশিস!

এ বিষয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক স্নেহাশিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। বহিষ্কারের খবরটি তিনি নিশ্চিত করেছেন। যদিও এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি। যোগাযোগ করা হয়েছিল সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও। ইমেল করে তাঁদের কাছে স্নেহাশিসকে বহিষ্কার করার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে স্বাতী অর্জুন উত্তর দিয়েছেন, “আপনাদের প্রশ্নের জবাবে জানাচ্ছি যে, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবিধির ৩৮.৫ ধারা অনুযায়ী ডঃ স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন (সার্ক)-ভুক্ত দেশগুলি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক। আগে দিল্লির চাণক্যপুরীতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখন ময়দানগঢ়হিতে। বিতর্কের সূত্রপাত ২০২২ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের কয়েক জন পড়ুয়া মাস গেলে পাঁচ হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন। কর্তৃপক্ষ তা কমিয়ে তিন হাজার টাকা করে দেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন পড়ুয়ারা। সেই আবহে মাসিক বৃত্তি বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়। যদিও পড়ুয়ারা নিজেদের দাবি থেকে পিছু হটেননি। তাঁরা দাবি করেন, মাসিক বৃত্তি সাত হাজার টাকা করতে হবে। তখন কর্তৃপক্ষ জানান, মাসিক বৃত্তি বাড়িয়ে আবার পাঁচ হাজার টাকা করা যেতে পারে। কিন্তু ছাত্রেরা তা মানতে চাননি। তাঁদের আরও একটি দাবি ছিল। তা হল, হেনস্থার ঘটনায় বিচারের জন্য তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটিতে পড়ুয়াদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে।

অভিযোগ, পড়ুয়াদের এই আন্দোলন দমাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকেন কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রে খবর, সেই পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ জন অধ্যাপক কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য, আন্দোলন করার গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে পড়ুয়াদের। যে ভাবে পুলিশ ডেকে আন্দোলন তোলার চেষ্টা হয়েছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির জন্য ভাল নয়। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানসূত্র খোঁজার পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই অধ্যাপকেরা। তাঁদেরই একজন স্নেহাশিস।

ঘটনাচক্রে, তার পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন পড়ুয়াকে বহিষ্কার করেন কর্তৃপক্ষ। তা নিয়ে ফের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখেন স্নেহাশিস-সহ ১৫ জন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, পড়ুয়াদের বহিষ্কার করার পদক্ষেপ নিয়ম মেনে হয়নি। এর পর ওই বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্নেহাশিস-সহ পাঁচ অধ্যাপককে শো কজ় করেন কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের দাবি, শো কজ়ে বলা হয়েছিল, ‘সহকর্মী, কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের বিরুদ্ধে’ গিয়ে পড়ুয়াদের উস্কানি দিয়েছেন অভিযুক্ত অধ্যাপকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশের পড়ুয়া-পরিচালিত মার্কসবাদী সংগঠন ‘আইজাজ আহমেদ স্টাডি সার্কল’-এর সঙ্গে তাঁরা যুক্ত কি না, শো কজ়ে সে প্রশ্নও তোলা হয় বলেও দাবি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রেই জানা গিয়েছে, পাঁচ জনের মধ্যে চার জন (স্নেহাশিস তাঁদের এক জন) শো কজ়ের জবাব দেন। তা খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ (তথ্যানুন্ধানকারী দল) গঠন করেন। ওই কমিটি অভিযুক্ত অধ্যাপকদের তলব করে। শুধু তা-ই নয়, সেখানে বসে একগুচ্ছ প্রশ্নের লিখিত জবাবও দিতে বলা হয়। বিষয়টি ‘অবমাননাকর’ বলে জানিয়ে তাতে রাজি হননি স্নেহাশিসেরা। তাঁরা জানান, কমিটি তাঁদের ইমেল করলে, সেখানে তাঁরা যাবতীয় প্রশ্নের জবাব দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি।

এর পর ২০২৩ সালের জুন মাসে স্নেহাশিস-সহ চার অধ্যাপককে সাসপেন্ড করে বিশ্ববিদ্যালয়। এর বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন অধ্যাপকেরা। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন পড়ুয়ারাও। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে পড়ুয়াদের মামলার রায় দেয় আদালত। তাতে কর্তৃপক্ষকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের নিন্দা করে অধ্যাপকেরা চিঠিতে যা লিখেছিলেন, সেই একই বক্তব্যই আরও ‘জোরালো’ ভাবে বলেছিল উচ্চ আদালত।

পড়ুয়াদের মামলার মীমাংসা হলেও, স্নেহাশিসদের সাসপেনশন-মামলার প্রেক্ষিতে দিল্লি হাই কোর্টের একক বেঞ্চ জানায়, তাদের এই মামলা শোনার এক্তিয়ার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও আদালতে জানান, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার সুবাদে কেন্দ্র তাদের রক্ষাকবচ দিয়েছে। সেই কারণেই তাঁদের বিরুদ্ধে এই ধরনের মামলা শোনা যায় না।

উচ্চ আদালতের ওই পর্যবেক্ষণের পরেই চার অধ্যাপককে ডেকে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (উপাচার্যের সমতুল্য পদ)। তাঁদের কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘ক্ষমা’ চাইতে হবে। আর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যাবে না। অভিযুক্ত চার অধ্যাপকের মধ্যে এক জন অস্থায়ী ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই ইরফানুল্লা ফারুকি নামে ওই অধ্যাপকের স্থায়ীকরণের প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু সাসপেনশনে থাকার ফলে বেশ কিছু নথি জমা দিতে না পারায় তাঁকে আর স্থায়ী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ করেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শর্তে বলা হয়েছিল, এই বিষয়টি নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। তেমনই খবর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে।

কর্তৃপক্ষের এই তিন শর্ত মেনে নিয়েছিলেন চার অধ্যাপকের মধ্যে দু’জন। তাঁরা ক্ষমা চেয়ে চাকরিও ফিরে পান। কিন্তু স্নেহাশিস রাজি হননি। এর পরেই হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন। আদালতে তাঁর বক্তব্য, তিনি কোনও ‘দোষ’ করেননি। যা করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির কথা ভেবেই করেছেন। নাগরিক হিসাবে তাঁর যেমন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে নিজের মতামত পেশ করার অধিকার দিয়েছে। নিজের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই যা করার করেছেন তিনি।

ডিভিশন বেঞ্চে স্নেহাশিসের মামলার পরেই একটি শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি গঠন করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ঘটনাচক্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি স্নেহাশিসের বিরুদ্ধে ৫২টি অভিযোগ তুলেছিলেন, সেই প্রক্টরও ছিলেন ওই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটিতে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে কমিটি স্নেহাশিসকে ডেকে পাঠিয়েছিল। পরে তারা একটি রিপোর্টও জমা দেয়। এর পরেই ১৮ অগস্ট শো কজ় করা হয় স্নেহাশিসকে। জানতে চাওয়া হয়, কেন তাঁকে বহিষ্কার করা হবে না। কিন্তু অভিযোগ, কমিটির রিপোর্ট তাঁর কাছে না পাঠিয়েই অধ্যাপককে শো কজ় করা হয়েছিল। বার বার চেয়ে পাঠানোর পর অবশ্য ওই রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল স্নেহাশিসকে। সূত্রের দাবি, ওই রিপোর্টে অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ওঠা মোট ৫২টি অভিযোগের তলায় তাঁর উত্তর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ ছিল। শেষে একটিই বাক্য— ‘দ্য চার্জ স্ট্যান্ডস প্রুভড’। বাংলা তর্জমা করলে হয়, ‘অতএব, অভিযোগ প্রমাণিত।’ কিন্তু আর কোনও ব্যাখ্যা শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, গত ৩০ অগস্ট স্নেহাশিস শো কজ়ের জবাব দিয়েছিলেন। এর পর বৃহস্পতিবার তিনি বহিষ্কারের চিঠি হাতে পান।

কিন্তু স্নেহাশিসের মামলা এখনও ডিভিশন বেঞ্চে রয়েছে। আগামী মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি রয়েছে। আপাতত সে দিকেই তাকিয়ে অধ্যাপক। প্রসঙ্গত, স্নেহাশিস আশুতোষ কলেজের ছাত্র। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকার নটরডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। ২০১০ সালে পিএইচডি শেষ করেন। ২০১১ সালে সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন তিনি।

South asian university Delhi High Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy