মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে খুনের মামলার তদন্তে এখনও পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মৃতের স্ত্রী উত্তরপ্রদেশে আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁকে আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রেফতার করতে ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশে পৌঁছে গিয়েছে মেঘালয় পুলিশের একটি দল। বাকিদের মধ্যে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশ থেকে, কাউকে মধ্যপ্রদেশ থেকে। ধৃতদের পাকড়াও করে মেঘালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে তদন্তকারীদের কাছে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরাই রয়ে গিয়েছে।
সোমবার ভোরে উত্তরপ্রদেশের গাজ়িপুর থানায় আত্মসমর্পণ করেন সোনম। কিছু ক্ষণের মধ্যেই জানা যায় ওই ঘটনায় আরও তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তখনও তাঁদের নামপরিচয় জানা যায়নি। দুপুরে মেঘালয় পুলিশ সাংবাদিক বৈঠক করে জানায়, ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন রাজ সিংহ কুশওয়াহাও। এই কুশওয়াহা আসলে সোনমের ‘প্রেমিক’ বলে দাবি করা হচ্ছে। যদিও পুলিশের তরফে এখনও পর্যন্ত তা নিশ্চিত করা হয়নি। সোনম আত্মসমর্পণ করার আগেই কুশওয়াহাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মধ্যপ্রদেশের ইনদওর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি দুই ধৃতের মধ্যে রয়েছেন বিশাল সিংহ চৌহান এবং আকাশ রাজপুত। বিকাশকে ধরা হয় ইনদওর থেকে। আকাশকে গ্রেফতার করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের ললিতপুর থেকে। সোমবার দুপুরে মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলা থেকে আরও এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর নামপরিচয় এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
শুধুই ত্রিকোণ প্রেম? না কি অন্য কারণ
চার জনকে গ্রেফতার করার পরেও বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরাই রয়ে গিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা রাজা রঘুবংশী গত ২৩ মে খুন হন। কেন তাঁকে খুন করা হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। মেঘালয়ে মধুচন্দ্রিমার পরিকল্পনা কি করা হয়েছিল খুনের জন্য? সোনম কি নিজেও সরাসরি খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? না কি তিনি শুধু হত্যাকাণ্ডের ছক কষেছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। রাজার দেহ যখন উদ্ধার হয়, তখন তাঁর দেহের সঙ্গে পরনে সোনার আংটি এবং সোনার চেন পাওয়া যায়নি। সেগুলি কি লুট হয়ে গিয়েছে? ধৃতেরাই কি সেগুলি লুট করছেন? তা হলে কি ওই লুটের জন্যই খুন করা হয়েছে? সেই প্রশ্নেরও উত্তর মেলেনি। সোনমের শাশুড়ির দাবি, মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে রাজাকে নাকি সোনার অলঙ্কার পরে থাকার জন্য জোর করতেন সোনম। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকেই খুন, না কি ডাকাতির ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অধরা আরও প্রশ্নের জবাব
বাকি যে তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের ভূমিকাও তদন্তের আওতায় রয়েছে। মধুচন্দ্রিমায় হত্যাকাণ্ডে তিন জন ভাড়াটে খুনি নিয়োগের বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, সোনম, রাজা বাদে বাকি যে তিন জন গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁরাই সেই ভাড়াটে খুনি। তাঁদের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ হল সোনমদের?
বিয়ের ১০ দিনের মাথায় গত ২০ মে সোনম এবং রাজা ইনদওর থেকে শিলংয়ে মধুচন্দ্রিমায় যান। ২৩ মে তাঁদের শেষ বার দেখা গিয়েছিল। পুলিশের দাবি, সেই দিনই খুন করা হয়েছিল রাজাকে। ২ জুন রাজার দেহ উদ্ধার হয়। তার পরে সোমবার আত্মসমর্পণ করেন সোনম। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সোনম কোথায় কোথায় ঘুরেছেন? তিনি কি ইচ্ছাকৃত ভাবেই আত্মগোপন করে ছিলেন? সোনমের পরিবার দাবি করেছিল তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে। তদন্তকে বিভ্রান্ত করতেই কি এমন দাবি করা হচ্ছিল? সেটিও তদন্তের আওতায় রয়েছে।
মোড় ঘুরল ট্যুর গাইডের বয়ানে
মেঘালয়ে ঘুরতে গিয়ে পর্যটকেরা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন, প্রথমে এই ভেবেই নিখোঁজদের খোঁজ শুরু করেছিল পুলিশ। কিন্তু রাজার দেহ উদ্ধারের পরেই পুলিশ নিশ্চিত হয়, তাঁকে খুন করা হয়েছে। সেই মতো বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। ওই সময় মেঘালয়ের এক ট্যুর গাইডের বয়ানে উঠে আসে তিন হিন্দিভাষীর কথা। অ্যালবার্ট নামের ওই গাইড দাবি করেছিলেন, তিনি ২৩ তারিখ রাজা এবং সোনমকে তিন যুবকের সঙ্গে পাহাড়ে উঠতে দেখেছিলেন। সে দিন সকাল ১০টা নাগাদ নোংরিয়াট থেকে মাওলাখিয়াটে ৩০০০ সিঁড়ি চড়ছিলেন দম্পতি। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও তিন জন। ধৃত তিন ভাড়াটে খুনিই অ্যালবার্টের দেখা তিন হিন্দিভাষী কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। রাজাকে খুন করার জন্য সোনম যে তাঁদের নিযুক্ত করেছিলেন, তা পুলিশকে জানিয়েছেন ধৃতেরা।
আরও পড়ুন:
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট: মাথায় দুই ‘মোক্ষম’ আঘাত
রাজার দেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ইতিমধ্যে হাতে পেয়েছে মেঘালয় পুলিশ। পুলিশ সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, তাঁর মাথার পিছনের দিকে ঘাড়ের উপরে একটি গভীর ক্ষত মিলেছে। কপালের উপরের দিকে আর একটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে আভাস, ধারালো কিছু দিয়ে মাথার দু’দিকে আঘাত করা হয়েছিল রাজা রঘুবংশীকে। পুলিশ সূত্রে খবর, রাজার শরীরে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে ‘সবচেয়ে মারাত্মক’ দুটো আঘাত ছিল মাথার দু’দিকে।
রাজ-সোনমের ‘প্রেম’
অনেকের দাবি, খুনের নেপথ্যে রয়েছে রাজের সঙ্গে সোনমের প্রেমের সম্পর্ক। বিয়ের আগে থেকেই সোনমের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। অভিযোগ, রাজাকে খুনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন এই রাজ। তাঁর সঙ্গে সোনমের একাধিক ফোনালাপের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রে দাবি। এমনকি, রাজার সঙ্গে সোনমের বিয়ের পরেও দু’জনের যোগাযোগ ছিল। পারিবারিক সূত্রে সোনমদের সানমাইকার ব্যবসা ছিল। স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে কর্মচারী হিসাবে কাজ করতেন ২১ বছর বয়সি রাজ। সেই সূত্রেই আলাপ হয়েছিল দু’জনের। প্রায়ই তাঁদের ফোনে কথা হত। মেঘালয় পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময় সোনমের সঙ্গেই ছিলেন রাজ। তবে তাঁর কী ভূমিকা ছিল হত্যাকাণ্ডে, তা তদন্তসাপেক্ষ।
যে ভাবে ধরা পড়লেন সোনম
রবিবার রাত ১টা নাগাদ উত্তরপ্রদেশের গাজি়পুরের একটি ধাবায় দেখা যায় সোনমকে। ধাবার মালিক সাহিল যাদব এই সাক্ষাতের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন তদন্তকারীদের। তিনিই পুলিশকে ফোন করে সোনমের খবর দেন বলে দাবি। সাহিল জানিয়েছেন, রাত ১টা নাগাদ কাঁদতে কাঁদতে তাঁর ধাবায় আসেন সোনম। বাড়িতে ফোন করতে চান। সাহিল নিজের ফোন সোনমকে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেন তরুণী। সাহিলের ফোনে সেই নম্বর এখনও রয়ে গিয়েছে। রাতে পুলিশকে ফোন করে সাহিল জানান সোনমের কথা। তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলে সোনম আত্মসমর্পণ করেন।
আরও পড়ুন:
কী বলছেন দুই পরিবারের সদস্যেরা
সোনমের বাবা দেবী সিংহের দাবি, তাঁর মেয়ে এমন কাজ করতেই পারেন না। গোটাটাই মেঘালয় পুলিশের তৈরি করা গল্প বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে জানিয়েছেন, সিবিআই তদন্ত হলেই গোটা বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, “প্রথম থেকে রাজ্য (মেঘালয়) সরকার মিথ্যা কথা বলছে। মেঘালয় পুলিশও মিথ্যা বলছে। কেন আমার মেয়ে এই কাজ করতে যাবে?” তবে সোনমের শাশুড়ি উমা রঘুবংশীর অভিযোগ, তাঁর সন্তানকে একপ্রকার জোর করেই মেঘালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সোনম। তাঁর বক্তব্য, সোনম নিজে থেকেই মেঘালয়ের বিমানের টিকিট কেটেছিলেন। বিমানের টিকিট কাটার আগে রাজার সঙ্গে কোনও আলোচনাই করেননি তিনি। তাঁর দাবি, সোনম সকলের সঙ্গে এত মিষ্টি ভাবে কথা বলতেন যে কারও মনে কোনও সন্দেহই হয়নি। সোনম দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলেছেন উমা। হত্যাকাণ্ডে কুশওয়াহার নাম জড়িয়ে যাওয়ার ফলে সোনমের দেওর বিপুল রঘুবংশীরও সন্দেহ, সোনম এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারেন। তবে যত ক্ষণ না সোনম নিজমুখে অপরাধের কথা স্বীকার করছেন, তত ক্ষণ বৌদিকে ‘অভিযুক্ত’ বলে মানতে চাইছেন না বিপুল।
(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় রাজা রঘুবংশীর খুন হওয়ার তারিখটি ভুলবশত ২৩ জুন লেখা হয়েছিল। তারিখটি আসলে ২৩ মে। গোচরে আসার পরেই তা সংশোধন করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী)