Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Shaheen Bagh

উচ্ছ্বাস বদলে অবিশ্বাস, রাস্তায় অনড় শাহিন বাগ

দিনের শেষটা প্রতিবাদীদের কাছে এমন তিক্ত ঠেকলেও, শুরুতে সমাধানের দরজা খোলার আশায় উন্মুখ ছিল শাহিন বাগ।

সরব: শাহিন বাগে এক দাদি। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

সরব: শাহিন বাগে এক দাদি। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:৩২
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত দুই মধ্যস্থতাকারীকে অভ্যর্থনা জানাতে মঞ্চে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে সভা শুরু। অথচ এ দিনের মতো তা শেষ হল ক্ষোভ আর অবিশ্বাসে!

গতকাল যতটা আশায় বুক বেঁধে বৈঠক শেষ হয়েছিল, এ দিন ততটাই হতাশ হল শাহিন বাগ। আর গত ৬৮ দিন ধরে রাস্তায় ছাউনিই যাঁদের ঘরবাড়ি, তাঁদের অনেকে বললেন, ‘‘আমাদের অবস্থান থেকে এক চুলও সরার প্রশ্ন নেই। যদি সিএএ-এনআরসি ফেরানোর কথা সরকারি ভাবে ঘোষণা করে কেন্দ্র, একমাত্র তখনই উঠব। নইলে গুলির সামনে বুক পাততেও রাজি!’’ অধিকাংশ জনেরই ক্ষোভ, ‘‘সিএএ-এনআরসি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ দূর করতে নয়, এঁরাও তা হলে এসেছেন শুধু রাস্তা খোলার তাগিদে।’’

দিনের শেষটা প্রতিবাদীদের কাছে এমন তিক্ত ঠেকলেও, শুরুতে সমাধানের দরজা খোলার আশায় উন্মুখ ছিল শাহিন বাগ। শামিয়ানার বাইরেও প্রবল ভিড়। দুই মধ্যস্থতাকারী সাধনা রামচন্দ্রন ও সঞ্জয় হেগড়ে পৌঁছতেই মঞ্চে গোলাপের পাপড়ি। নিজেদের সমস্যা গুছিয়ে বলতে আগাম আলাপ-আলোচনা সেরে রাখা। এমনকি, সাধনা আলোচনা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাকে ছাউনির বাইরে যেতে বলার পরে, তা নিয়ে আপত্তি গিলে ফেলে দেওয়া হল হাততালি। শাহিন বাগ তখন নিশ্চিত, দেরিতে হলেও তাঁদের দুঃখ শোনার, যন্ত্রণা বোঝার লোক এসেছেন।

প্রত্যাশার পারদ আরও চড়ল, যখন নতুন ভোর আসার স্বপ্ন দেখালেন প্রতিনিধিরা। ‘কত প্রধানমন্ত্রী এসেছেন-গিয়েছেন।... তাঁরও ভুল হতে পারে’ শুনে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল জনতা।

হেগড়ে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কে বলেছে আপনারা এই দেশের নাগরিক নন?’’ ভিড় গর্জে উঠল, ‘‘নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ।’’ কখনও দু’-চার লাইন উর্দু তো কখনও শাহিন বাগের লড়াইয়ের ঢালাও প্রশংসা শুনে তখন প্রতিবাদীদের অনেকে নিশ্চিত, ‘‘এত দিনের ডাকে সাড়া দিয়ে উপরওয়ালাই এঁদের পাঠিয়েছেন।’’ সেই বিশ্বাসে ভর করে আবার সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করলেন প্রতিবাদীরা। প্রশ্ন উঠল, দেশে এত বিক্ষোভ সত্ত্বেও কেন সিএএ-এনআরসি প্রত্যাহারের কথা বলছে না সরকার? ‘কিন্তু’র দেওয়াল উঠতে শুরু করল তখনই। মধ্যস্থতাকারীরা বললেন, ‘‘আগের দিনই এ সম্পর্কে আপনাদের ক্ষোভ, উদ্বেগ, সমস্যা আমরা শুনেছি। চেষ্টা করেছি বোঝার। কিন্তু আজ আলোচনার মূল বিষয় অধিকার। প্রতিবাদ করা যেমন আপনাদের অধিকার, তেমনই রাস্তা ব্যবহার করতে পারা অন্যদের অধিকার। এ নিয়ে কথা বলতেই এখানে আসা।’’

বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা সাধনা রামচন্দ্রন ও সঞ্জয় হেগড়ের। এএফপি

মুহূর্তে বদলে গেল আবহ। ভিড় থেকে প্রশ্ন উঠল, ‘‘তা হলে ওটাই একমাত্র সমস্যা? আর আমরা যে এ দেশে থাকার অধিকার, ভিটে-মাটি হারাতে বসেছি তার বেলা?’’ উত্তর এল, ‘‘আমরা সেই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু একই কথা বার বার বলতে থাকলে, সময়ের অপচয় হবে।’’

মধ্যস্থতাকারীদের তরফ থেকে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা হল আলোচনার বিষয়ও। বলা হল, সিএএ নিয়ে মামলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। সেখানে জোরদার সওয়াল হোক। কিন্তু তার রায় না-আসা পর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে এক চুলও না-নড়ার পণ করে থাকলে তো আর কথাই এগোবে না। হেগড়ে মনে করালেন, শাহিন বাগকে দেখেই আন্দোলন দানা বাঁধছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তাদের সামনে নমনীয়তার দৃষ্টান্তও তুলে ধরা জরুরি।

চারপাশের গুঞ্জন তত ক্ষণে চেহারা নিয়েছে শোরগোলের। ভিড় এক বাক্যে বলছে, ‘‘আন্দোলন চলবে শাহিন বাগে। এখানে, এই রাস্তাতেই।’’ যুক্তি, এখান থেকে সরে গেলে আন্দোলনের ধার কমবে। তাঁদের কথা শুনতে আসবেন না আর কেউই।

সাধনা প্রস্তাব দিলেন, ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য কাল থেকে বরং তাঁরা আলাদা-আলাদা ভাবে কথা বলবেন ১০-২০ জনের ছোট-ছোট দলের সঙ্গে। এই ছাউনিতেই। প্রতিবাদীরা তেমন সায় দিলেন না। মধ্যস্থতাকারীদের মঞ্চ থেকে নেমে এসে সকলের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথার প্রস্তাবও একই ভাবে ফিরিয়েছেন তাঁরা।

এই টানাপড়েনে নিষ্ফলাই থাকল আলোচনা। কখনও জামিয়ার সামনে ‘মোদীকেও ভয় পাই না’ বলা ভদ্রলোক এখানে কেঁদে বললেন, ‘এই হিন্দুস্তানকে আমি খুব ভয় পাই। বাচ্চাদের কী হবে জানি না।’’ আবার কখনও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে চোখ ছলছল হল প্রতিবাদীর। কিন্তু যাওয়ার আগে মধ্যস্থতাকারীরা শুধু বলে গেলেন, ‘‘ফলপ্রসূ বৈঠক সম্ভব হলে, তবেই আসার কোনও অর্থ হয়। সেই পরিবেশ এখনও নেই।’’

বিকল্প পথের সন্ধানী মধ্যস্থতাকারীরা কাল ফিরবেন কি না, স্পষ্ট নয়। আদালত সিএএ সম্পর্কে কী রায় দেবে, তা অজানা। রাস্তা আটকে এ ভাবে আর কত দিন, তা-ও অস্পষ্ট। বিশেষত মধ্যস্থতাকারীরাও যেখানে ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, নমনীয় না-হলে, বসতে দেওয়া-না-দেওয়া শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে শুধু সরকার আর পুলিশের উপরে।

এই পরিস্থিতিতে দিনের শেষে নার্গিস, নিলোফার, খালিদ, মারিয়মরা বলছিলেন, ‘‘সব যেতে বসেছে। এ বার প্রতিবাদে রাস্তায় বসার অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চায়! সরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। তার থেকে গুলি খাওয়া ভাল!’’

আটকে থাকা সড়কের বিকল্প রাস্তা খোলা সম্ভব কি না, জানা নেই। কিন্তু আলোচনায় সমাধানের রাস্তা পাওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দূর অস্ত্‌।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE