আদালতে লড়াই করার মতো অর্থ ছিল না ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের হাতে। কারণ, তাঁর দুই পুত্র রাহুল এবং রবীন মুখোপাধ্যায় মায়ের জমানো টাকা থেকে দামি গয়না, সব চুরি করেছিলেন। শিনা বরা হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী বিধি মুখোপাধ্যায় মঙ্গলবার এমন দাবি করেন আদালতে। একই সঙ্গে তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধেও চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেছেন ইন্দ্রাণীর মেয়ে। তিনি জানান, তাঁর বক্তব্য বলে তদন্তের নথিতে সিবিআই যেগুলো সংযুক্ত করেছে, সব জাল এবং বানানো!
মঙ্গলবার সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে শিনা হত্যা মামলার শুনানি হয়। সেখানে ইন্দ্রাণী এবং তাঁর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্নার কন্যা বিধি জানিয়েছেন মায়ের জমানো সম্পত্তি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। কপর্দকশূন্য ছিলেন তিনি। কারণ, সৎদাদারা মায়ের গচ্ছিত অর্থ এবং গয়না আত্মসাৎ করেন। বিচারক জেপি দারেকরের এজলাসে বিধি বলেন, ‘‘পিটার মুখোপাধ্যায়ের দুই ছেলে আমার মায়ের সর্বস্ব চুরি করেছিলেন।’’ সাক্ষীর সংযোজন, ‘‘ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়কে (এখন জামিনে রয়েছেন) মিথ্যা মামলায় জড়ানোর স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল দু’জনের। ওই সময়ে দু’জনের কারও আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। রাহুল মুখোপাধ্যায় বেকার ছিলেন। রবীন মুখোপাধ্যায়ও আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ওঁরা মায়ের টাকা-গয়না চুরির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।’’ বিধির দাবি, সেই কারণে তাঁর মা যাতে কোনও ভাবে জেল থেকে ছাড়া না-পান সেই চেষ্টা করে গিয়েছেন দুই সৎভাই।
২৫ বছরের শিনা চাকরি করতেন মুম্বইয়ে। ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সিবিআইয়ের দাবি, ২০১২ সালেই শিনাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন তাঁর মা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়, তাঁর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জীব খন্না এবং চালক শ্যামবর রাই। এর পর পেন গ্রামে নিয়ে গিয়ে সেই দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১২ সালে পেন থানার পুলিশ সেই হাড়গোড় উদ্ধার করে জেজে হাসপাতালে পাঠায়। ফরেন্সিক পরীক্ষা করানো হয়। যদিও সেগুলি কার, তার খোঁজ মেলেনি দীর্ঘ দিন। ২০১৫ সালে ইন্দ্রাণীর চালক শ্যামবরকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে জেরা করেই প্রকাশ্যে আসে শিনার হত্যার বিষয়টি। এর পর খারা খানার পুলিশ ওই জায়গায় গিয়ে হাড়গোড়ের বাকি অংশ উদ্ধার করে দিল্লির এমসে পরীক্ষার জন্য পাঠায়। সিবিআইয়ের দাবি, ২০১২ এবং ২০১৫ সালে যে হাড়গোড় উদ্ধার হয়েছে, তা শিনার। যদিও ইন্দ্রাণীর আইনজীবীরা তা মানেননি। ২০১৫ সালের নভেম্বরেই গ্রেফতার হন ইন্দ্রাণীর স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায়। সৎমেয়ের খুনের নেপথ্যে তাঁরও চক্রান্ত ছিল বলে দাবি করা হয়। গাড়িচালক এবং ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন স্বামী সঞ্জয় অপরাধ স্বীকার করেন বলে দাবি। কিন্তু ইন্দ্রাণী এবং পিটারের দাবি, শিনা বেঁচে আছেন এবং তিনি থাকেন আমেরিকায়। পরে আবার বয়ান বদল করেন ইন্দ্রাণী। তখন তিনি জানান, তাঁর মনে হচ্ছে, মেয়ে এখন কাশ্মীরের কোথাও থাকেন।
ওই হত্যা মামলা যখন সামনে আসে বিধি তখন নেহাতই নাবালিকা। আদালতে তিনি জানান, মায়ের গ্রেফতারিতে যে মানসিক আঘাত তিনি পেয়েছিলেন, সেই ক্ষত এখনও বয়ে চলেছেন। ওই তরুণী জানান, তাঁকে মুম্বই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পরে সিবিআই আধিকারিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তদন্তকারীদের কাছে কোনও বিবৃতি রেকর্ড করার কথা অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, সিবিআইয়ের অফিসে ইমেলের একটি কপি (শিনার সঙ্গে তার কথিত কথোপকথন) এবং সাদা কাগজ-সহ বেশ কয়েকটি নথিতে স্বাক্ষর করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল। আদালতে জবানবন্দির সময় সিবিআই চার্জশিটের অংশ হিসাবে যখন বিধিকে তাঁর বিবৃতি দেখানো হয়, তখন তিনি দাবি করেন সেগুলো ভুয়ো। তিনি এমন কিছু রেকর্ড করতে বলেননি। তিনি বলেন, ‘‘আমার বাবা-মা সঞ্জীব খন্না এবং ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়কে এই মামলায় মিথ্যা ভাবে জড়ানোর জন্য আমার বিবৃতি জাল এবং বিকৃত করা হয়েছে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এর নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে।’’
আরও পড়ুন:
সিবিআই আদালতে বিধি মনে করিয়ে দেন কী ভাবে শিনা ইন্দ্রাণীকে তাঁর দিদি বলে দাবি করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে বোরা এবং ইন্দ্রাণী অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু পিটার মুখোপাধ্যায়ের ছেলে রাহুল তাঁদের মধ্য মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে যাতায়াত শুরু করার পরেই বিরোধ শুরু হয়।’’ ইন্দ্রাণী এবং রাহুলের মেয়ের আরও দাবি, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন পরিবারের সকলে জানতে পারেন যে রাহুল মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছেন। একই ভাবে বোরাও নেশার জালে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
বিধি আদালতকে জানিয়েছেন তিনি বোরাকে শেষ বার দেখেছেন ২০১১ সালে গোয়ায়, একটি বিয়েবাড়িতে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তাঁদের ইমেলে যোগাযোগ ছিল। যদিও তদন্তকারীদের দাবি, ওই মেল করতেন ইন্দ্রাণীই। তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, বোরা বেঁচে আছেন। বিধি তা মানতে নারাজ। তিনি ২০১৫ সালের অগস্টে তাঁর মায়ের গ্রেফতারির পর সৎবাবা পিটারের পরিবারের আচরণের ‘ভয়াবহ ছবি’ তুলে ধরেন আদালতে। তিনি জানান, তাঁদের বাড়িতে আসা আত্মীয়স্বজনেরা ইন্দ্রাণীর জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ঝগড়া করতেন। এমনকি, সুগন্ধির শিশি এবং ব্যাগের দখল নিয়ে ঝগড়া করতেন তাঁরা। সৎদাদা রব়ীন তাঁকে ভয় দেখিয়েছিলেন, ‘মুখার্জি বংশ’ অথবা তাঁর মা, যে কোনও এক পক্ষকে বেছে নিতে হবে তাঁকে। এমনকি, এ-ও বলেন, তিনি যদি মুখোপাধ্যায়দের পক্ষ না-নেন পারিবারিক সম্পত্তি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা হবে। বাড়ির কোনও জিনিসই তিনি দাবি করতে পারবেন না। এর পরেই বিধি দাবি করেন, ‘‘মায়ের গয়না চুরি যাওয়ার পরে রাহুল এবং রবীন মুখোপাধ্যায়ের নামে একটি নতুন ব্যাঙ্ক লকার খোলা হয়েছিল।’’